মাত্র ২২ বছরের জীবন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানটি তবু নিজের শ্রেণীর সীমানা ও নিষেধ ভাঙতে সমর্থ হয়েছিলেন। ছিলেন বিপ্লবী,জাতীয়তাবাদী নয়; সমাজবিপ্লবী। শারীরিক ব্যাধি ছিল, তা কাটিয়ে দিন-রাত কাজ করতেন, সারাদিন পার্টির কাজ, রাতভর হারিকেনের আলোতে লিখে যেতেন। এমনও হতো রাত ফুরিয়ে কখন সকাল হয়েছে খেয়াল করেননি। সে সময় মফস্বল শহর ঢাকাতে থাকার কারণে প্রকাশের সুযোগ তেমন ছিল না, তবু ওই বয়সে কথাসাহিত্যে অসাধারণ প্রতিভার সাক্ষর রেখেছিলেন।

তাঁর ছোটগল্পে মানুষের অবয়ব, পোশাক, পরিস্থিতি কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। তবু সবকিছু বলে দেননি, পাঠককে অনুমান ও কল্পনা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত যে তাঁর গল্পের মতোই তাঁকেও ঘাতকদের ছুরিতেই নিহত হতে হবে তা নিশ্চয় জানতেন না। কিন্তু আন্দাজ করেছিলেন যে ওই রকমেরই একটি জাতীয়তাবাদী শক্তি ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নিয়ে হৃষ্টপুষ্ট ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।

বাংলা ভাষায় ‘দাঙ্গা’ নিয়ে মনে হয় প্রথম গল্প লিখেছিলেন সোমেন চন্দ। পরবর্তীতে হাসান হাফিজুর রহমান, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নবেন্দু ঘোষ, সমরেশ বসু সহ অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু সোমেন চন্দ্রই পথিকৃৎ। তাঁর অন্য বেশ কয়েকটি সফল গল্পের মতোই তিনি দাঙ্গা গল্পটিতেও সাহিত্য এবং রাজনীতিকে নান্দনিকতায় মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

২৪ মে সোমেন চন্দের জন্মদিন। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ তিনি গুন্ডাদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। সোমেন যখন দক্ষিণ মৈশুণ্ডিতে থাকতেন তখন মাঝে মধ্যেইহিন্দু-মুসলিম, মুসলিম-খ্রিস্টানদের মধ্যে বিরোধ হত। পরবর্তীতে ১৯৪১ সালে ঢাকা শহরে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, সেই ঘটনাসোমেনেরমনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। সেই কলঙ্কিত ইতিহাস নিয়েই তিনি‘দাঙ্গা’ গল্পটি লিখেছিলেন। সে সময় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গোটা দেশবাসী সংগ্রাম করছে। সোমেনের মনে হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামীদের কেউ হয়ত দাঙ্গায় প্রভাবিত হতে পারেন। সেই উৎকণ্ঠা থেকেই তিনি ‘দাঙ্গা’ গল্পটি লিখেছিলেন।

দাঙ্গার অসার উত্তেজনা, তার বিস্তার দেখে মর্মপীড়িত, স্পর্শকাতর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সোমেনের তরুণ মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার স্বরূপ ফুটিয়ে তুলতেই যেন তিনি ব্রতী হয়েছিলেন। সেকারণেই রাজনৈতিক মতাদর্শ আর মানুষের মনঃপ্রতিক্রিয়া মিলেমিশে‘দাঙ্গা’ একটি সার্থক রাজনৈতিক গল্পে পরিণত হয়। সোমেন তাঁর দেশকে এবং দেশের মানুষকে কতখানি দরদ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন তাঁর প্রমাণ মেলে গল্পের নায়ক অশোকের কথায়,‘আগামী নতুন সভ্যতার যারা বীজ, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আমি যোগ দিয়েছি, তাদের সুখ-দুঃখ আমারও সুখ-দুঃখ। আমি যেমন বর্তমানের সৈনিক, আগামী দিনেরও সৈনিক বটে। সেজন্য আমার গর্বের আর সীমা নেই। আমি জানি আজকের চক্রান্ত সেদিন ব্যর্থ হবে, প্রতিক্রিয়ার ধোঁয়া শূন্যে মিলাবে। আমি আজকের থেকে দ্বিগুণ কর্তব্যপরায়ণ হলাম, আমার কোনো ভয় নেই।’

লেখালেখিই ছিল তাঁর সাধনক্ষেত্র। ঢাকা তখন নিতান্তই মফস্বল একটি জনপদ। বাংলা সাহিত্য ও চিন্তাচর্চার প্রাণকেন্দ্র তখন কলকাতা। ঢাকায় রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন প্রগতিশীল লেখক-কর্মীদের ‘ফ্রেন্ড, ফিলসফার ও গাইড’। রণেশ দাশগুপ্ত প্রগতি সাহিত্যের মর্মকথা নামে একটি ছোট পুস্তিকাও লিখেছিলেন। সোমেন সেটি আত্মস্থ করেছিলেন। পড়েছিলেন জন লেমান সম্পাদিত পেঙ্গুইন নিউ রাইটিং ইন ইউরোপ, ই এম ফরস্টার, স্টিফেন স্পেন্ডার, জন কর্নফোর্ড, সিসিল ডে লুইস, ইগনাৎ দিয়ো সিলোনে, আঁদ্রে মালরোর কিছু বই।পড়েছিলেন আপটন সিনক্লেয়ারের উপন্যাস, জোসেফ মাৎসিনির লেখা ডিউটিজ অব ম্যান, এছাড়াও বার্নার্ড শ, তলস্তয়, ম্যাক্সিম গোর্কি।

জীবনে একবারই কলকাতায় যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। ছিলেন সবুজ বাংলার কথা পত্রিকার সম্পাদক নির্মল কুমার ঘোষের বাড়িতে। দেখা হয়েছিল বিনয় ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী,হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মানিক বন্দ্যাপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছিলেন কিন্তু দেখা পাননি। কলকাতায় তাঁর একমাত্র ছবিটি তুলেছিলেন বন্ধু গৌরপ্রিয় দাশবন্ধু।

১৯৪২ সালের ৮ মার্চ সোমেন চন্দ গুন্ডাদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পরে পরিচয় পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৪ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যুর পটভূমিকায় একটি মাত্র লোকের মৃত্যু তুচ্ছ ব্যাপার মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বিশেষ পরিবেশে একজনের মৃত্যু বহু মৃত্যুর চাইতে বেশি অর্থবহ হতে পারে। সোমেন চন্দের মৃত্যু এই জাতীয়।…’

যারা তাঁকে হত্যা করেছিল তাদের দুর্বৃত্ত, গুন্ডা, ভাড়াকরা লোক কি বলা যায়? তারা তো রাজনীতিরই লোক, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির। সে সময় জাতীয়তাবাদীরা শক্তিশালী,হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের বিরোধীতা দাঙ্গায় পরিণত হয়েছিল। তবে সোমেন চন্দ মুসলমান জাতীয়তাবাদীদের ছুরিতে প্রাণ হারান নি। সোমেনকে শত্রু চিহ্নিতকরে, রেল শ্রমিকদের মিছিল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির লোক যারা দেশপ্রেমিক বলেই পরিচিত।কারণ, তারা ফরওয়ার্ড ব্লক ও রেভ্যুলেশনারী সোশালিস্ট পার্টির লোক ছিল। জাতীয়তাবাদীরা অন্ধব হয়ে গিয়েছিল,তারা মনে করেছিল কমিউনিস্টরা দেশদ্রোহী,ব্রিটিশের লোক, কাজেই ঘরের শত্রু বিভীষণকে ওই সময় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সোমেন চন্দ ইস্ট বেঙ্গল রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

সোমেন চন্দ্র হত্যার ঘটনায় ১৯৪২-এর ২৩ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ইন্দিরা দেবী, আবু সৈয়দ আইয়ুব, প্রমথনাথ বিশী, সুবোধ ঘোষ, সমর সেন, অরুণ মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ বিবৃতি দেন, “পূর্ব হইতে চিন্তা করিয়া ও সম্পূর্ণ অকারণেই তাঁহাকে হত্যা করা হইয়াছে এবং সম্ভবত তাঁহার বিপক্ষ দলই এই কার্য করিয়াছে।” সুকান্ত ভট্টাচার্যের বয়স তখন ষোলো, কবিতা লিখেক্ষোভ প্রকাশ করেন, ‘বিদেশী-চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদ্-বৃন্তে/ সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে’। বুদ্ধদেব বসু ক্রোধ উগরে দেন, ‘ক্ষমা? এরও ক্ষমা আছে? এ উন্মত্ত হননবৃত্তিরে’। তবে পুলিশ ওই হত্যা নিয়ে কোনো কেস ফাইল করেনি বা কাউকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি।

সোমেন চন্দের সত্তরতম জন্মবর্ষ উপলক্ষে যে গ্রন্থপ্রকাশ হয়েছিল সেখানে অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র ‘ক্ষতবিক্ষত সেই মৃতদেহ’ শিরোনামে লেখেন, ‘তিনি গল্প লিখতেন বলে খুন হননি, মিছিল নিয়ে আসছিলেন বলেই খুন করা হয়েছিল তাঁকে।…’ সোমেন চন্দ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই খুন হয়েছিলেন। অনেকের মতে ভারতে ফ্যাসিবাদের হাতে প্রথম বলি। ফ্যাসি বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ সোমেন চন্দ শতবর্ষ পেরিয়েছেন তারপরও গৌরী লঙ্কেশের মতো সাংবাদিকদের হত্যা কাণ্ড ঘটেই চলে।

Share.

1 Comment

  1. সোমেন চন্দ র সম্বন্ধে কিছুই প্রায় জানি না, শুধু তিনি বিশিষ্ট সাড়া জাগানো লেখক ছিলেন, এখনো লোকে তার অকাল মৃত্যু নিয়ে আক্ষেপ করে এইটুকু ছাড়া। তাঁর নামে পুরস্কার ও আছে জানি। কিন্তু এইটুকুই জানা ছিল। আপনার লেখা পড়ে দাঙ্গা পড়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। খুঁজে বার করতে হবে। পড়তে হবে।

Leave A Reply

Exit mobile version