বর্তমানে কয়েক বছর ধরে টোটো বা টুকটুক মফস্বল শহরগুলোতে ছেয়ে গেছে। কলকাতায় অবশ্য এখনো সেভাবে দেখা যায় না, প্রধান সড়ক থেকে কম দূরত্বের পাড়ায় যাওয়ার জন্য এখনো রিক্সাই সম্বল। মফস্বল শহরগুলোতে পথে টোটো আসাতে সাধারণ মানুষের সুবিধা হয়েছে, রিক্সার তুলনায় কম পয়সায় অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারছে দেখে সাধারণ মানুষ টোটোর দিকে বেশি ঝুঁকছে। তাই পথে রিক্সা খুব কম দেখা যায়। রিক্সাচালকেরা টোটোর চাহিদা দেখে ধার-দেনা করে অনেকে টোটো কিনেছে। কিন্তু গরীব রিক্সাচালক অনেকেই টোটো কিনতে পারেনি। অনেকে বহু-বছর ধরে রিক্সা চালাচ্ছে, রিক্সা চালানো ছাড়া নতুন কোনো কাজও তাদেরপক্ষেকরাসম্ভবনয়। তারা আগের পুরোনো রিক্সা নিয়েই পথে যাত্রীর আশায় হা-পিত‍্যেশ করে বসে থাকে। কোনোদিন দু-একটা ভাড়া হয়, কোনোদিন একদম হয়না।

আমাদের দেশে অধিকাংশ রিক্সাচালকের নিজস্ব রিক্সা নেই। মালিকের কাছ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে কিছু টাকার বিনিময়ে ভাড়া নেয়। তারপর সেই রিক্সাচালকেরা হাড়-কাঁপানো শীতে, প্রচন্ড গ্রীষ্মে, ঘোর বর্ষায় ভোর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত অমানবিক পরিশ্রম করে। কয়েকটা টাকার বিনিময়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এত পরিশ্রম করেও রিক্সাচালকদের যে খুব বেশি রোজগার হয় তা নয়। তারা শহরের বস্তি এলাকায় বসবাস করে, অথবা শহরের উপকণ্ঠে গরির মানুষের বসবাস যোগ্য জায়গায় বসবাস করে।এই দুর্মূল্যের বাজারে গরিব রিক্সাচালকদের ঘরে নেমেছে চরম দুর্দিন।পরিবারের মুখে দু-বেলা দু-মুঠো খাবার জোটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বাড়ির মেয়ে বৌয়েরা অন্যের বাড়ি কাজ করে সংসারের কিছুটা হাল ধরেছে।

ঘোড়ার গাড়ি এবং মোটরকার আসার পর যেমন পালকির সুদিন ঘুচে গিয়েছিল, এখন অটো আর টোটো আগমনের পর ঘটেছে ঠিক এক অবস্থা। রিক্সার কফিনে শেষ পেরেক বসিয়ে দিয়েছে অটো আরটোটো। জাপান থেকে চিনের সাংহাই হয়ে একদিন এই যান কলকাতায় এসেছিল। সেদিন তাকে লালনপালন ও ভরণপোষণ করেছিল কলকাতার আদি চিনে বাসিন্দারা। সেদিনের রিক্সা ছিল মানুষের হাতে টানা এবং দুই চাকার। অনেক পরে রিকশায় চেন বসে। রিক্সার পুরো নাম ‘জিন-রি-কি-শ’। জাপানি ভাষায় যার অর্থ ‘মানুষ টানা গাড়ি’। জাপান থেকে এই গাড়ি পৌঁছয় চিনের সাংহাই শহরে। ভারতে রিকশার চাকা গড়াতে শুরু করে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে, সিমলায়।লেডি ডাফরিন তাঁর স্মৃতিকথায় সিমলায় রিকশা আগমনের কথা লিখেছেন। প্রথম দিকের ‘জেনি রিকশা’ বা ‘জিন রিকশা’ ক্রমে ক্রমে লোকের মুখে মুখে হয়ে যায় রিক্সা।

সিমলা থেকে কলকাতায় রিক্সা আগমন ঘটতে সময় লেগেছিল ২০ বছর। কলকাতায় বসবাস করা চিন দেশের কিছু সংখ্যক মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই কলকাতায় রিক্সা নিয়ে এসেছিলেন। তারাই ছিলেন কলকাতার প্রথম রিকশাচালক, অন্তত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত। কিন্তুতাদের সেই একচ্ছত্র আধিপত্যও খুব  বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের আধিপত্য ভারতীয়রাই দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ভারতীয়রাই এই পেশায় আধিপত্য বিস্তার করে। তবে গোড়ায় যে হাতেটানা রিক্সা ছিল তার চালক হিসেবে বিহারের মানুষই অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়েছে। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিক পর্যন্ত ১ মাইল পর্যন্ত ২ জন আরোহীর ক্ষেত্রে রিকশার ভাড়া ছিল ৩ আনা। তার পর মাইলপিছু ভাড়া বাড়ত ৩ আনা করে।কখনও আবার ভাড়া নির্ধাতির হত সময়ের নিরিখেও। ১ ঘণ্টা পর্যন্ত ভাড়া ছিল ৬ আনা। সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে ঘণ্টাপিছু ভাড়া যোগ হত ৩ আনা করে।

এখন পথে অটো, টোটো নেমে যাওয়াতে রিক্সা চালকদের অবস্থা খুব করুন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ এলাকাতেই অটো টোটো চালু হওয়াতে রিক্সাচালকেরা ভাড়ার অপেক্ষায় হা পিত্যেশ করে বসে থাকেন, কিন্তু বেশিরভাগ যাত্রী তুলনায় দ্রুত যান এবং কম ভাড়ায় অটো বা টোটোতে উঠে গন্তব্যে চলে যান। কেবলমাত্র এলাকার অলিগলিতে যাওয়ার জন্য এখনও কিছু জায়গায় রিক্সাই ভরসা। তবে ‘কাঠফাটা রোদে, ঝড়-বাদলেতে, শীতের রাতে…’ যারা রিক্সা চালায় তাদের বিকল্প ব্যবস্থা কিছু তৈরি হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে যে তাদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে পড়বে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version