অপূর্ব মিত্র

তৃতীয় পর্ব

ইয়াকের কথা —
এর মধ্যে যাদের সম্বন্ধে বলতে একদম ভুলে গেছি অথচ তাদের উপস্থিতি অস্বীকার করা কোনো মতেই সম্ভব নয়। এদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ইয়াকের প্রসঙ্গ। এত বিশাল শরীর নিয়ে এত শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রাণী আমি গরু, মোষ বা অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আর মানুষ তো একেবারেই পড়ে না। ওদের পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে দিয়ে যতক্ষন পর্য্যন্ত না বিশেষ সংকেত অর্থাৎ একমাত্র মালিকের শীষের বা আওয়াজ পায়, দাঁড়িয়েই থাকে। আবার যেমনি কমান্ড পেল চলতে শুরু করল। আর থামা একমাত্র ট্রেকার্স হাটেই, অন্য কোথাও নয় ! একা একাই আগে পৌঁছে গিয়ে মালিকের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। এপথে ওদের খাবারের কোনো অভাব নেই, তাই বলে ডিউটির সময় অন্য কোনো কাজ বিশেষ করে কচি ঘাস পাতা চিবানো একদম নয়। এমনই সংযম। ডিউটি মানে ডিউটি। এরকম ডেডিকেশন হয়তো ওখানে ছিল বলে জায়গাটা স্বর্গে পরিণত হয়েছে। আর একই ধরণের একগুঁয়েমি লক্ষ্য করেছিলাম জোঁকের মধ্যে। কেউ ওদের নাগালের মধ্যে এলেই সে মাটি থেকে হোক আর চারা গাছের ডাল থেকেই হোক তাদের টার্গেট থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল। যদিও জানে ইয়াক, শিয়াল, ভাল্লুক, হাতি বা বাঘ তাদের কাছে শান্ত ক্যাটাগরির আর একমাত্র মানুষই হিংস্র প্রকৃতির। এই যে শ্রেণী বিন্যাস করতে পাড়ার ক্ষমতা তা যে কত বড় বুদ্ধির ব্যাপার আমরা যারা মানুষ হিসাবে পরিচয় দিই তারাও লজ্জায় পড়ে যাব।

পায়ে পায়ে জোংরির পথে —
পরের দিনের গন্তব্য জোংরি। এই পথটা অনেকটা চড়াই এবং স্বল্প দূরত্বের মধ্যে অনেকটা উঁচুতে ওঠা। তবে পথ পাকদন্ডী বেয়ে নয়। সোজা উপরের দিকে উঠে যাওয়া, আর যাবার রাস্তাটা শুধুমাত্র বাঁ দিকেই বেঁকে গেছে, একেবারে শেষ মুহূর্তে জোংরি টপের আগে বাঁক নিয়েছে ডানদিকে ।
খুব সকাল সকাল সোকা থেকে রওনা দিয়ে প্রায় ঘন্টা তিনেক ট্রেক করার পর আমরা গাঢ় নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে এক অনন্য সুন্দর সবুজ ঘাসে ঢাকা বিস্তীর্ণ জমিতে পৌঁছালাম। সেই সবুজ জমির চার দিকে রডোডেনড্রনের জঙ্গল। এই উচ্চতাতেও কত না পাখির সমাবেশ সেখানে। এক স্বর্গীয় অনুভূতি। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত ভালোবাসা, সম্পদ নিঃশেষে উজাড় করে দিয়েছে। আপ্লুত মনে সৃষ্টিকর্তাকে প্রনাম জানালাম। কে যেন আবৃত্তি করে উঠল – ” শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।” তিন ঘন্টার পরিশ্রম ভুলেই গেলাম। শুধু দুই চোখ ভোরে দেখা আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করা। কেউ কারো দিকে তাকানোর ফুরসৎ নেই। সবাই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ। একবাক্যে স্বীকার করে নিতেই হল – আসা সার্থক।


হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের মধ্যে শুভাশিষ নেই । সবাই ডাকাডাকি শুরু করে দিলাম । তখনি একটা গাছে পাখিদের ব্যস্ততা, চেয়ে দেখি শুভাশিস প্রায় নুইয়ে থাকা একটা শ্যাওলা ভরা রডডেনড্রন গাছের ডাল থেকে নেমে আসছে। সকালের আবশ্যিক কাজটি না সেরে আসার বিপদ আর কি।
ওখান থেকে জোংরির রাস্তা বলতে মনে হচ্ছিল আমরা যেন গড়ের মাঠের উপর দিয়ে আড়া আড়ি ভাবে পাড়ি দিচ্ছি। চারিদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ আর যেদিকেই তাকাই শুধুই ফুলে ভরা রডডেনড্রন এর জঙ্গল। আর প্রকৃতি যেন আমাদেরই অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তার মাঝে সবুজ গালিচা পেতে রেখেছিল। ঠিক যেন পটে আঁকা, এতটাই নয়নাভিরাম কথায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে আরো ঘন্টা দুয়েক পর আমরা পৌঁছালাম জোংরি ট্রেকার্স হাটে। স্বাভাবিক ভাবেই সকলে বেশ ক্লান্ত। পৌঁছেই যে যেমন ছিলাম তেমন অবস্থাতেই গা এলিয়ে পড়লাম। কিন্তু পেটে দানাপানি চাই। খানিক বিশ্রামের পর সমীর লেগে পড়লো ফের খিচুড়ি বানাতে। আমরা আহার পর্ব মিটিয়ে সাততাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। বেশ ঠান্ডা। হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শুধু শীতবস্ত্রে ঠান্ডা বাধা মানে না… অতএব রেন কোট আর বুট পড়েই ঘুমোবার চেষ্টা। কোনরকমে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুতেই ঘুম নেমে এল। কাল গন্তব্য স্বপ্নের জোংরি টপ।

অবশেষে…….

অ্যালার্ম ঠিক সময়েই বেজেছিল। রাত তখন দু’টো। ঘন অন্ধকারের প্রেক্ষাপটে মাথার উপর অসংখ্য তারা নিয়ে জেগে রয়েছে রাতের আকাশ। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে বেড়িয়ে এসেছি সেই তারা ভরা আকাশের নীচে। শুধু ঠকঠক করে কাঁপছি। কারো মুখে কথা নেই। সার বেঁধে পর পর টর্চ জ্বালিয়ে গাইডকে অনুসরণ করতে করতে যন্ত্রের মত এগিয়ে চলেছি জোংরি টপের দিকে। জোংরি ট্রেকার্স হাটের কেয়ার ট্রেকারই আপাতত আমাদের এ পথের গাইড। এ এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। নিশুত রাতে টর্চের আলোয় পায়ে চলার পথ ছাড়া আশপাশের কিছুই দেখার উপায় নেই। খুব সতর্কভাবে চলতে হচ্ছে। কারণ পায়ের তলায় পথ আসলে পাহাড়ের বোল্ডারের উপর দিয়ে। পাহাড়ের গায়েও বরফের মধ্যে বোল্ডার আটকে আছে । রোদ উঠলে বরফ গলে পাহাড় থেকে বোল্ডার খসে পড়ে। আবহাওয়াও খারাপ হবে, তাই রাত্রেই রওনা। প্রায় ঘন্টা দুয়েক নিঃশব্দ ট্রেকিংয়ের পর জোংরি শিখরের নীচে পৌঁছালাম। পাহাড়টা সম্পূর্ণ ঝুরো বরফের। আমাদের গাইড বারবার তাকে অনুসরণ করতে বলছিল। ও যেখানে যেখানে পা ফেলছিল, আমরাও ঠিক সেখানে সেখানেই পা ফেলে তর তর করে এগিয়ে চলেছি। একসময় এমন একটা জায়গায় পৌঁছালাম, যেখানেই পা ফেলছি পা প্রায় হাঁটু পর্য্যন্ত বরফে ঢুকে যাচ্ছে, আর এগোনো যায় না। অবশ্য আর এগোনোর দরকারও ছিল না। গাইড জানাল, আমরা এখন প্রায় সাড়ে চৌদ্দ হাজার ফুট শীর্ষে জোংরি টপে রয়েছি। ইতিমধ্যে আকাশে হালকা আলোর রেখা ফুটে উঠেছে। তার সঙ্গে সঙ্গেই এতক্ষণের অন্ধ রাতের সঙ্গী নক্ষত্ররা বিদায় নিচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাতখন সূর্য্য ওঠার অপেক্ষায়। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না। হঠাৎ এতক্ষণ আবছায়া হয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার মুকুটে লাল আভা লাগলো…… আস্তে আস্তে আরও লাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা অঙ্গে …… ক্রমে হালকা সোনালী …… ভারী সোনালী ও বেশ কিছুক্ষন পরে রুপালি আলোর জাদুতে অন্ধকার চিরে জেগে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমরাও তুষার শৃঙ্গে রঙের খেলায় মেতে রইলাম অপার বিস্ময়ে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে প্রনাম জানানোর উদ্দেশে গুন গুন করে গেয়ে উঠলাম –
“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে।”

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version