দুদিন আগে পর্যন্ত ওডিশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রায়রঙ্গপুরের বৈদাপোসি গ্রামের নাম সেই গাঁয়ের মানুষছাড়া কেউই প্রায় জানতনা। কিন্তু গতদুদিন ধরে সংবাদ শিরোনাম থেকে দেশের রাজনীতি চর্চার কেন্দ্র বিন্দুতে উঠে এসেছে বৈদাপোসি গ্রাম এবং রায়রঙ্গপুর। 

কারণ, ১৮ জুলাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য যে ভোট গ্রহণ করা হবে তাতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বৈদাপোসি গ্রামেরই ভূমিকন্যা দ্রৌপদী মুর্মু ( Draupadi Murmu )। কেবল মহিলা নন দ্রৌপদী মুর্মু আদিবাসী জনজাতি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। এর আগে ভারতে প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন প্রতিভা পাতিল।এরপর বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট পাটনার রাজভবন থেকে রামনাথ কোবিন্দ কে তুলে এনে চমক দিয়েছিল। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করা বিজেপির ‘মাস্টারস্ট্রোক’। তাদের মতে, দলিত নেতা রামনাথ কোবিন্দের পরে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দ্রৌপদীকে প্রার্থী করে এ বার বিজেপি বিরোধী জোটকে টেক্কা দেবে।

প্রসঙ্গত, শরদ পাওয়ার, ফারুক আবদুল্লাহ এবং গোপালকৃষ্ণ গান্ধী বিরোধী জোটের প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর বিরোধী জোট যশবন্ত সিনহাকে প্রার্থী করেছে। অন্য দিকে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নায়ডু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন বলে জল্পনা দানা বেঁধেছিল।কিন্তু বিজেপিএবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মহিলা মুখকে সামনে রেখেই এগোতে চাইছিল। তাদের আলোচনায় ছিল তিন জন মহিলা- তামিলসাই সৌন্দরাজন, আনন্দীবেন প্যাটেল ও দ্রৌপদী মুর্মু। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, এবং দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা-সহ বিজেপির সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে এই তিন মহিলা নাম নিয়েই আলোচনা হয়। বৈঠকের পরে দলের সভাপতি জেপি নড্ডা তফসিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের নেত্রী দ্রৌপদীর নাম ঘোষণা করেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ দ্রৌপদী মুর্মুর ( Draupadi Murmu ) নাম বিবেচনার মধ্যে ছিল। শেষ মুহুর্তে দলিত নেতা রামনাথ কোবিন্দকে মনোনীত করা হয়। কিন্তু দলিতের পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আদিবাসী প্রার্থী কেন? এখন পর্যন্ত উপজাতি সম্প্রদায়ের কেউই দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। এই অবস্থায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট উপজাতীয় নেত্রী দ্রৌপদী মুর্মুকে দেশের সর্বোচ্চ পদে বসাতে চাইছে। দ্রৌপদী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হলে তিনিই হবেন দেশের প্রথম আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি

বিজেপির অঙ্ক হল, আগামী বছর গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ে বিধানসভা নির্বাচন। এই চারটি রাজ্যে তফসিলি উপজাতিদের জন্য ১২৮টি আসন সংরক্ষিত।২০১৭-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ওই ১২৮টি আসনের মধ্যে জিতেছিল মাত্র ৩৫টি আসন।রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজেপি আদিবাসী মহিলাকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করে উপজাতীয় ভোটারদের প্রভাবিত করতে চাইছে। একই ভাবে, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এবং জেএমএম নেতা হেমন্ত সোরেনকেও বিজেপি খুশি করার চেষ্টা করছে। হেমন্ত সোরেনের জেএমএম উপজাতীয় রাজনীতির জন্যই বিশেষ পরিচিত।  সোরেনের পক্ষে একজন উপজাতীয় মহিলার বিরোধিতা করা খুব সহিজ হবে না। তাছাড়া দ্রৌপদী মুর্মু ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল ছিলেন। পাশাপাশি বিজেপির অঙ্কে রয়েছে ভারতীয় আদিবাসী পার্টির মতো কিছু ছোট দল, যাদের গুজরাত ও রাজস্থানে কিছু বিধায়ক আছে। এছাড়াও, ওড়িষায় ক্ষমতাসীন বিজেডি সরকারের থেকেও বিজেপি সমর্থন পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। দ্রৌপদী মুর্মু রায়রঙ্গপুর থেকে বিধানসভা ভোটে জিতে ওডিশায় বিজেপি-বিজেডি জোট সরকারে বাণিজ্য ও পরিবহণ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাছাড়া মৎস্য ও পশুপালন দফতরেরও মন্ত্রী হয়েছিলেন।ইতিমধ্যে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেডি নেতা নবীন পট্টনায়েক দ্রৌপদী মুর্মু প্রার্থি পদের জন্য বিবেচিত হওয়ায় তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন।

চলতি বছর গুজরাতে এবং ২০২৩ সালে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে নির্বাচন হওয়ার কথা।এই চার রাজ্যেই আদিবাসী ভোটাররা নির্ধারক ভূমিকায় রয়েছে। যদি এই চারটি রাজ্যে উপজাতীয় আসনগুলির ফলাফল বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে বিজেপির থেকে কংগ্রেস অনেক এগিয়ে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির আদিবাসী কার্ড আসলে রাজনৈতিক কৌশল। হিসেবে দেখা হচ্ছে। দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হলে শুধুমাত্র চার রাজ্যের বিধানসভা নয়,২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি উপজাতীয় অঞ্চলের ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই আদিবাসী ভোট নিয়ে বিজেপি দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করতে চেয়ে বড় বাজি খেললো।

ওডিশার আদিবাসী নেত্রী দ্রৌপদী মুর্মু স্বাধীনতার ৭৫ বছরে যদি নির্বাচিত হন, তাহলে তিনি হবেন দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি একই সঙ্গে দ্বিতীয় মহিলা রাষ্ট্রপতি। এমনকী স্বাধীনতার পর জন্মগ্রহণ করা প্রথম রাষ্ট্রপতি। প্রসঙ্গত, ওডিশার ভূমিপুত্রী হিসেবে দ্বিতীয়, এর আগে ওডিশা থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ভি ভি গিরি।যখন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মেয়াদ শেষ হয়, তখনও দ্রৌপদী মুর্মুর নাম উঠেছিল। কারণ তিনি খোদ নরেন্দ্র মোদির বিশেষ পছন্দের প্রার্থী। কিন্তু সে সময় দল রামনাথ কোবিন্দকে চাওয়ায় পিছিয়ে পড়েন দ্রৌপদী।
Share.

4 Comments

  1. shuvasish sengupta on

    ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়েই বিজেপি ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন রাজ্যপাল দ্রৌপদী মুর্মুকে বেছে নিয়েছেন। ওড়িশার যে অঞ্চলের বাসিন্দা দ্রৌপদী মুর্মু, সেখানকার মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত। আবার ঝাড়খণ্ড, যেখানে দ্রৌপদী মুর্মু রাজ্যপাল ছিলেন, সেথানকার জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত।

  2. Pingback: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থীপদে মনোনয়ন পত্র পেশ করলেন দ্রৌপদী মুর্মু

  3. jayanta choudhury on

    লোকসভায় ৫৪৩টি আসনের মধ্যে তফশিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে ৬২টি আসন। সব মিলিয়ে বিজেপি মনে করছে দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করে জনজাতি সমাজকে বিশেষ বার্তা দেওয়া গেল। সবচেয়ে বড় কথা বিজেপি প্রচারে বলতে পারবে তফশিলি জনজাতিদের পাশাপাশি মহিলাদের অন্যান্য দলের তুলনায় বেশি প্রাধান্য দেয় বলেই তারা দ্রৌপদীকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছে।

Leave A Reply

Exit mobile version