ড. দেবদুলাল ঠাকুর
সহযোগী অধ্যাপক
সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, পুনে

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ নিঃসন্দেহে একটি গঠনমূলক পদক্ষেপ। আর কিছু না-হোক, প্রাথমিক স্তরে মাতৃ ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কথা যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মাতৃ ভাষা মাতৃ দুগ্ধের সমান। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় যে প্রত্যেক মানুষকেই তার শৈশবে যদি মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া যেত তাহলে হয়তো সমাজ আরও গঠনমূলক হত। যাগ্গে , সে অন্য কথা।
বর্তমানের ১০ + ২ মডেলকে বাতিল করে এই শিক্ষানীতি বয়স ভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ, এখন বিষয়সূচি এমনভাবে সাজানো হবে যাতে সেই বিষয় সূচি নির্দিষ্ট বয়সের কথা ভাবে। যেমনটা অনেক উন্নত দেশে হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে এই ধরণের মডেল শিক্ষার ভিতকে অনেক শক্তপোক্ত করে। তবে, এটাও মানতে হবে যে , এই ধরণের উন্নত মানের শিক্ষার ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে গেলে দরকার উন্নত পরিকাঠামো এবং প্রতিনিয়ত সুচারু প্রশিক্ষণ। আমাদের দেশে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের যে প্রাথমিক পরিকাঠামো তাতে এই ধরণের প্রগতিশীল ভাবনা বাস্তবায়িত করতে গেলে যে ধরণের মানসিকতা, আর্থিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, তা কিন্তু প্রশ্নাতীত নয়।
বলা হয়েছে যে সত্যি তো স্কুলের ব্যাগ তো বড্ডো ভারি, তাই শুধু পাঠ্য বই নয়, এবার জোর দেওয়া হবে সামগ্রিক বিকাশের উপর। দরকার নেই বিজ্ঞান বা কলা শাখাকে বজ্রআঁটুনি দিয়ে আলাদা করার, দরকার নেই পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত বা তার বহির্ভূত বিষয়কে আলাদা ভাবে দেখার। বরং সবটাই যেন এক বৃহৎ শিক্ষার আঙ্গিনা।সেখানে বেড়ে উঠুক আমাদের আগামী প্রজন্ম। শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকার আগামী দিনে আরও ব্যয় করুক , এটাই কাম্য। মনে রাখা দরকার যে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ কিন্তু এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।পরবর্তীতে তাপস মজুমদার কমিটির রিপোর্ট-র অনেক সুপারিশও কিন্তু এখনো শুধু বিতর্কের জায়গাতেই আটকে আছে, বাস্তবায়ন দুরস্ত। শুধুমাত্র একটি প্রস্তাব এনে বা লোকসভাতে সেটা পাস করিয়ে বোধহয় এর রূপায়ণ সম্ভব নয়। অতীতেও এমন অনেক শিক্ষা নীতি এসেছে বা শিক্ষা সংক্রান্ত্র অনেক কমিশন হয়েছে। কিন্তু তাদের দেখানো পথ আজও অধরাই। পরিকাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষকেই এর হাল ধরতে হবে। আর ঠিক এই জায়গাটাই আমাকে বড্ডো ভাবাচ্ছে। আমাদের দেশ নানা ভাষা নানা মতের দেশ। সেখানে এই শিক্ষা নীতি কোনো ভাবে এই বিবিধতার যে মৌলিক রূপ, তার রূপান্তর ঘটাবে না তো ? শিক্ষা যেখানে মূলত সাংবিধানিক ভাবে রাজ্যের বিষয়, তাই এর এই কেন্দ্রীকরণ আখেরে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর চরিত্র বদলে দেবে না তো ? পাশাপাশি, যে সমস্ত রেগুলেটরি বডির কথা বলা হয়েছে, তাদের আধিপত্য কোনোভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাড়তি যান্ত্রিকতা ঘটাবে না তো ? বিদেশি পুঁজিকে যদি শিক্ষার মতো বিষয়ে উন্মুক্ত করা হয়, তাতে আখেরে কি আমাদের সত্যি কোনো উন্নতি হবে ? এমন হাজারো প্রশ্ন থেকেই যায়, ভবিষ্য কালই এর উত্তর দেবে।
আপাতত এই মুহূর্তে এটুকুই বলা যায় যে দেরিতে হলেও কোথাও একটা ভাবনা চিন্তা চলছে শিক্ষার মান, পরিবেশ এবং পরিকাঠামোকে উন্নত করার। এক্ষুনি অন্তত এইটুকুকে সাধুবাদ জানাই, বাকিটা আগামীর উপর ছেড়ে দিলাম।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version