সূর্য গুপ্ত | ছবি- PTI

রাষ্ট্রীয় শোক আমার জ্ঞানত প্রথম দেখেছি ১৯৮৪ সালে। কচি কিশোরবেলায়। অদ্ভুত নিষ্পাপ শিশুর জগতে। তখন ক্রিকেট খেলা আজকের মতো বাজারি হয়ে যায়নি। আর শৈশব ও আজকের মতো দরকচা ছিল না। যেদিন টিভিতে খেলা হতো, সেই দিনগুলো স্কুল যাওয়ার সময় গলায় কান্নার দলা আটকে থাকতো , সাহস ছিল না বলার যে, আজকে প্লিজ খেলা দেখি। স্কুল ছুটি পৌনে চারটে। কোন কোন মাস্টারমশাই আবার একটু বেশিক্ষণ পড়াতেন। স্কুল থেকে রেল কোয়ার্টার্স দেড় কিলোমিটার- খেলা না থাকলে পঁচিশ মিনিটে হেলেদুলে কিন্তু খেলা থাকলে- ভাগ মিলখা ভাগ । সকালে বেড়োনোর সময় দেখে এসেছি ইন্ডিয়া ব্যাট করবে- পাকিস্তানের সাথে খেলা। স্কুল থেকে বেড়িয়ে বিদ্যুত গতিতে হাইন্ডমার্শের মোড়ের চায়ের দোকান- ক্বাককাকু…স্কোর কতো? হাঁপিয়ে গেলে আবার বেশি তোতলাতে থাকি। কাকু বেজার মুখে বললেন, বেঙ্গসরকর সেঞ্চুরি করেছিল, তারপর খেলার কমেন্ট্রি হচ্ছে না ….শেষ কথাটা কানে ঢোকার আগেই ফের দৌড়।বাড়ি ফিরে টিভিতে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে পড়তেই, ও হরি, খেলা ফেলা কিছু নেই শুধু এক ভদ্রলোক একমনে কি সব বলে যাচ্ছেন ! অক্টোবর মাস শেষ, মফস্বল এখন হাফ সোয়েটার পড়ে ফেলেছে আর মাঠেও ব্যাটবল। সাড়ে পাঁচটার সময় বাড়ি ফিরে দেখি বড়রা রেডিও চালিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে- প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গুলি করেছে কারা, তিনি হাসপাতালে।রাজীব গান্ধী তাঁর সফর বাতিল করে দিল্লি ফিরছেন। আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল শুনে, জ্ঞান হওয়া ইস্তক তো জানতাম প্রধানমন্ত্রী বললেই ইন্দিরা গান্ধী বলতে হয়। সন্ধ্যা একটু গভীর হতেই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ঘোষণা হলো সেই মর্মান্তিক খবরের- ইন্দিরা আজকে তাঁর দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত।পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী শ্রী রাজীব গান্ধী এবং দেশে পরবর্তী তের দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। সেই প্রথম অপলক নয়নে ধরা দিলেন প্রিয়াঙ্কা- অপূর্ব সেই আলোকে আলোকিত হলাম । সেই প্রথম জানলাম আমার প্রিয় নায়ক অমিতাভ বচ্চন রাজীব গান্ধীর খুব কাছের বন্ধু। তের দিন ধরে টিভিতে গান হয়েছিল খালি গলায়, বেহালা বেজেছিল একা আর খবর পড়া হতো চাপা স্বরে।
রাজীব গান্ধী যখন নিহত হন তখন আমরা স্কুলের শেষ দিকে। উনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না তখন, কিন্তু সবাই জানতো এই ভোটে উনিই ফিরছেন। তখন সদ্য লালকৃষ্ণ আডবাণী আর মুরলী মনোহর যোশীর নাম শুনছি আমরা, আর কিছুদিন আগেই দেশ নাড়িয়ে দিয়ে গেছে বোফর্স আর মন্ডল কমিশন। হঠাৎ একদিন সকালে ঘুমের মধ্যেই শুনছি বাইরে অনেক লোক একসাথে হয়ে কি আলোচনা করছে।তাড়াতাড়ি বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বাবা? বাবা বললো, কাল রাতে রাজীব গান্ধী বোমার আঘাতে মারা গেছেন। সত্যি সত্যি খুব খারাপ লেগেছিল- অত সুন্দর একটা ভদ্রলোক! ওরকম মিষ্টি হাসি, কি করে মারতে পারলো!! রাষ্ট্রীয় শোক-তখনো শুধু একটাই চ্যানেল, কিন্তু এবার টিভিতে ওরকম শোক ছিল না। পৃথিবী বড় হতে শুরু করেছিল, শিখতে শুরু করেছিল- লেটস মুভ অন।

সাড়ে পাঁচটার সময় বাড়ি ফিরে দেখি বড়রা রেডিও চালিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে- প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গুলি করেছে কারা, তিনি হাসপাতালে।রাজীব গান্ধী তাঁর সফর বাতিল করে দিল্লি ফিরছেন। আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল শুনে, জ্ঞান হওয়া ইস্তক তো জানতাম প্রধানমন্ত্রী বললেই ইন্দিরা গান্ধী বলতে হয়। সন্ধ্যা একটু গভীর হতেই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ঘোষণা হলো সেই মর্মান্তিক খবরের- ইন্দিরা আজকে তাঁর দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত।পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী শ্রী রাজীব গান্ধী এবং দেশে পরবর্তী তের দিনের রাষ্ট্রীয় শোক।

তারপর কত কত সময় চলে গেছে- শেষ কুড়ি-তিরিশ বছর পৃথিবীর দুহাজার বছরের সভ্যতাকে নিঙড়ে মুচড়ে রস বের করতে শিখেছে মানুষ। ইন্দিরা আর রাজীবের মৃত্যুর পরের দিন আমরা খবরের কাগজ পাইনি। দুজন মারা গেছিলেন নিজের দেশের মানুষের হাতে, কত তদন্ত হয়ে কিছু সত্যি প্রকাশ্যে এসেছে কিছু কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কালক্রমে পৃথিবীতে এসেছে সতেরশো টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট। মিডিয়া, নেট, বাইট এই কথাগুলো নতুন মানে নিয়ে অভিধানে ঢুকে পড়েছে পাকাপাকিভাবে। এই পৃথিবীতে- আজকে রাজত্ব করে সোশ্যাল মিডিয়া, খবরের কাগজ মৃত্যুশয্যায়, টিভি চ্যানেলগুলো লড়াই করছে খেউড়ের, কোনওরকমে টিঁকে থাকার জন্য। এই পৃথিবী সব সারল্য হারিয়েছে- রাষ্ট্রীয় শোক আজ তিনটে অক্ষর হয়ে টিঁকে আছে মোবাইলে মোবাইলে-RIP !!!!

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version