দ্বিতীয় পর্ব

ইন্দ্রনীল বসু

সিআইএসএফ কনস্টেবল বিষ্ণু দাসের দেহ নদীতে থেকে উদ্ধারের পর জানা গিয়েছিল, শ্বাসরোধ করে খুনের পর তাঁকে জলে ফেলে দেওয়া হয়। এর পর ২০১৬-র জানুয়ারিতে দক্ষিণ বন্দর থানায় খুনের মামলা দায়ের করে শুরু হয় এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত।

একে একে সামনে আসে নানান তথ্য। জানা যায়, ১৯৯৭ সালে আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা বিষ্ণু দাস সিআইএসএফের যোগ দেন। হত্যার ৩ বছর আগেই বদলি হয়ে এসেছিলেন কলকাতা বন্দর এলাকায়। কর্মরত ছিলেন সিআইএসএফের গোয়েন্দা শাখায়। আর থাকতেন বন্দরেরই সুভাষ নগর এলাকার বুরুক লেনে। ২০১৬-র ৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে আটটা নাগাদ খিদিরপুর ডকের ৩ নম্বর বিটে ডিউটিতে ছিলেন তিনি।

যেখান থেকে বিষ্ণুর জুতো, টিফিন বক্স ও অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার হয়, সেটি আসলে ছোট একটি অফিসঘর। খিদিরপুর ডকের ৩ নম্বর বিটে ওয়্যারহাউসের কারশেডে অবস্থিত ওই অফিস ঘরটি। সেখানে বসেন সিআইএসএফের কর্মীরা। কিন্তু বিষ্ণুর সহকর্মী ও পুলিশের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, কে বা কারা, কী কারণে খুন করল বিষ্ণুকে। সেই রাতে ডিউটির সময় এমন কিছু কী দেখে ফেলেছিলেন বিষ্ণু, যার জন্য তাঁর প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়!

তদন্তে নামে দক্ষিণ বন্দর থানার পুলিশ। নদী থেকে দেহ উদ্ধারের পর বিষ্ণুর জামার পকেট থেকে তাঁর মোবাইল ফোন খুঁজে পায় পুলিশ। ফোনের কল রেকর্ড খুঁজে পুলিশ জানতে পারে, সেই রাতে ডিউটিতে যোগ দেওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে, প্রায় সন্ধে সাতটা নাগাদ একটি ফোন করেছিল তিনি। সেই ফোনের পর আর কাউকে ফোন করেননি বা কারও ফোন আসেওনি।

৯ জানুয়ারির রাতে বিষ্ণু ছাড়াও সেখানে ডিউটিতে ছিলেন আরও ৭ জন সিআইএসএফ জওয়ান। এক এক করে জেরা করা হয় তাঁদের প্রত্যেককে। এমনকি রেকর্ড করা হয় বাহিনীর অন্যান্য কর্মীদের বয়ানও। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, যে রাতে বিষ্ণুকে খুন করা হয়, সেই রাতে সিআইএসএফের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ৩ নম্বর বিটের সুপারভাইজার সেখানে যাননি। না-যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে, ওই সুপারভাইজার বলেন, আশপাশে ঘুরে দেখার পর, তেমন কোনও অস্বাভাবিকতা চোখে না-পড়ায় ৩ নম্বর বিটে যাননি তিনি। কিন্তু তাঁর এই উত্তর সন্তুষ্ট করতে পারেনি তদন্তকারীদের। সুপারভাইজারের বয়ানে উপস্থিত আরও কিছু অসঙ্গতি ভাবিয়ে তুলেছিল পুলিশকে। এর পরও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও, তাঁর কাছ থেকে কোনও সুবিধা করতে পারেনি পুলিশ।

বিষ্ণুর সহকর্মী ও অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদের পর এবার পালা বন্দরে পণ্য খালাস বা তুলতে আসা লরির চালক ও খালাসিদের। বিষ্ণু দাসের হত্যায় তাঁদের কোনও হাত থাকতে পারে কি না, সে দিকটিও খতিয়ে দেখা শুরু করল পুলিশ। ওই রাতে ডকে আসা লরি-ট্রেলারের চালক-খালাসিদের এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

উল্লেখ্য, নেতাজি সুভাষ ডকে আসা বড় জাহাজের জিনিসপত্র ছোট ছোট বার্জে করে খিদিরপুর ডকে নিয়ে আসা হত। তদন্তকারী দল জানতে পারে, ২০১৬-র ৯ জানুয়ারি রাতে এমনই দুটি বার্জ এসেছিল খিদিরপুর ডকে। সেই বার্জের সারংদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদে কোনও আশার আলো না-পেয়ে শেষে স্নিফার ডগ দিয়ে তল্লাশি শুরু হয়। কারশেড থেকে শুরু করে নদীর দিকে, একাধিক বার তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল স্নিফার ডগের সাহায্যে। এমনকি একটি বার্জেও উঠেছিল পুলিশের কুকুরটি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এতেও লাভ হল না কিছুই। তদন্তের দিশা হারালো পুলিশ।

তদন্তকারীদের মাথায় তখন বহিরাগত ব্যক্তির মাধ্যমে খুনের তত্ত্ব ঘুরপাক খাওয়া শুরু করেছে। বহিরাগত কোনও ব্যক্তি কী সে রাতে ডকে এসেছিল? কিন্তু এ ক্ষেত্রেও হাত খালিই থাকে পুলিশের। এই তত্ত্ব প্রমাণের জন্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারত সিসিটিভি ক্যামেরা। কিন্তু ডকের ৩ নম্বর বিট বা তার আশপাশে কোনও সিসিটিভিই বসানো ছিল না।

ইতিমধ্যে সন্দেহের তালিকায় থাকা সুপারভাইজার বদলির ফরমান পান। তদন্তের স্বার্থে ওই বদলিতে আপত্তি জানায় পুলিশ। সে কারণে সিআইএসএফ তাঁর বদলিও স্থগিত করে। কিন্তু বহু দিন হয়ে গেলেও কোনও অগ্রগতিই ঘটেনি মামলার। আর তাই সুপারভাইজারের পরবর্তী বদলিকেও আটকানো যায়নি। বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান সেই সুপারভাইজার।

তদন্ত না-এগোনোর ফলে ধীরে ধীরে বিষ্ণু দাস হত্যা মামলার ফাইলে ধুলো জমতে শুরু করে। এক বার অবশ্য সেই ফাইল ঝেড়ে তোলা হয়, তবে সেটি শুধুই আধিকারিক ভাবে ক্লোজ করার জন্য।

হত্যার পর যেমন বিষ্ণুর দেহকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনই আজও হয়তো স্বাধীন বাতাসে গা ভাসিয়ে, মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করছে বিষ্ণু-র হত্যাকারী।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version