পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ এবং খাদ্য সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটছে, বিশেষ করে জলবায়ু বদলের কারণে। পৃথিবীর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং পরিবেশের অন্যান্য পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনের উপর প্রভাব পড়ছে। যে কারণে কিছু ঐতিহ্যবাহী খাদ্য থেকে আর আগের মতো স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের গুণগত মানও কমে যাচ্ছে। একথা ঠিক যে বিশ্বায়নের কারণে ফাস্ট ফুড এবং আন্তর্জাতিক খাবারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে এবং সেগুলি ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্থান দখল কর নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, ঐতিহ্যবাহী খাদ্য উৎপাদন করে তাকে বাজারজাত করা লাভজনক হচ্ছে না, কারণ মানুষ সেগুলির ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কিছু অঞ্চলে নির্দিষ্ট সবজি বা ফল উৎপাদন কমে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী খাদ্য তৈরি করতে সমস্যা হচ্ছে। ফাস্ট ফুড এবং জাঙ্ক ফুড অতিরিক্ত জনপ্রিয় হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী খাবারে আগ্রহ কমেছে।
সব দেশেরই শহর বা গ্রামের নিজস্ব কিছু খাদ্য থাকে এবং তাদের স্বাদ জিভে লেগে থাকে। বহুকাল ধরে মানুষ খেয়ে আসায় সেগুলি লোকজ বা ঐতিহ্যবাহী খাদ্য হয়ে ওঠে স্থানীয় উপাদান ব্যবহারে এবং রান্নার ধারায়। যা আসলে একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। কিন্তু আজ রান্নার সেই স্বাদ প্রায় অমিল। গবেষণা বলছে, ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে যাচ্ছে। এক একটি অঞ্চলে উৎপন্ন উপাদান, প্রস্তুত প্রণালি আর বহু বছরের রীতি ও নীতিতে তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী এক একটি খাবার। এই সব খাবার যুগ যুগান্ত ধরে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। কখনো কখনো এই স্বাদই হয়ে ওঠে সেই দেশ বা এলাকার ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই। কিন্তু ‘জার্নাল অব ফুডস’-এর এক গবেষণা জানাচ্ছে, জলবায়ুর কারণে পরিবেশ এমন ভাবে ধ্বংস হয়েছে বা পরিবর্তীত হয়েছে, যার প্রভাবে ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের স্বাদেও পরিবর্তন ঘটেছে।
আমরা জানি যে খাদ্য মুখে দেওয়ার পর আমাদের জিবের স্নায়ুগুলি খাদ্যের রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাদ তৈরি করে। রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে খাদ্য উপাদানের গন্ধ ইত্যাদি ইত্যাদির মিশ্রণে স্বকীয় একটি স্বাদ তৈরি হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় স্বাদ মূলত একটি অভিজ্ঞতা; যা আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। অন্য দিকে খাবারের রাসায়নিক যৌগগুলি গঠিত হয় তাপমাত্রা, মাটি, বৃষ্টিপাত, সূর্যালোক ও কীটপতঙ্গের মতো পরিবেশগত মূল উপাদানের মাধ্যমে বা প্রভাবে। ‘আওয়ার চেঞ্জিং মেনু’ বইতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের পরিবর্তন খাদ্যের প্রতিটি উপাদানকে প্রভাবিত করছে। বিশেষঙ্গের মতে, ‘উচ্চ তাপমাত্রা টমেটোতে চিনির মাত্রা বাড়ায়। ফলে এটি মিষ্টি হয়ে ওঠে। আবার অন্যদিকে উষ্ণ আবহাওয়া লেটুসে ল্যাকটোনের মাত্রা বাড়ায়, যাতে লেটুস তেতো হয়ে ওঠে।’ ঠিক যেমন শুকনো মাটি পেঁয়াজকে আরও তীক্ষ্ণ ও সালফারযুক্ত করে।
কেবল মাটিতে জন্মানো সবুজ ফেসল নয়, পশুজাত পণ্য, যেমন পনিরও জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন ২০১২ সালে আমেরিকার উইসকনসিনে চরম খরা ও তাপমাত্রার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হযয়েছিল। সেই সময় স্থানীয় পনিরের স্বাদে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছিল। বিশেষঙ্গরা বলেন, তাজা ঘাসের অভাবে দুগ্ধচাষীরা গবাদিপশুর জন্য খড় ব্যবহার করতে বাধ্য হন। সেই খাদ্য পরিবর্তন দুধের স্বাদকে প্রভাবিত করে, যা পনিরের স্বাদে পরিবর্তন আনে। আর সেই কারণে উইসকনসিনের ড্রিফটলেস অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পনিরের স্বাদ অনেকটাই বদলে যায়। চীনের ইউনান অঞ্চলের বন্য মধুর অনন্য স্বাদ তৈরি হয় পাহাড়ি ফুল নেক্টার থেকে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত নেক্টারের স্বাদে বদল ঘটিয়েছে, যার ফলে মধুর সুগন্ধ ও ঘনত্বকে কমিয়ে দিয়েছে।
একইভাবে কোরিয়ার জাতীয় ফসল বাঁধাকপির স্বাদ ও সুগন্ধ তীব্র তাপের কারণে প্রায় নষ্ট হতে বসেছে। জানা যায়, কিমচি তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁধাকপি আর তাতে সব উপাদান না থাকলে এই ফসলের গুরুত্ব কমে যাবে। কারণ কিমচি কোরিয়ানদের পরিচয় ও গর্বের প্রতীক। কোরিয়ানদের মতে, কিমচি ছাড়া তাদের খাওয়ার টেবিল শুধু নয়, ওটি না থাকলে তারা খাবারের ঐতিহ্য হারাব। স্পেনের ঐতিহ্যবাহী স্টু ‘ওলা পোরতাদা’ প্রায় ছশো বছর ধরে স্প্যানিশ রন্ধনশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই স্টুর প্রধান উপাদান স্প্যানিশ লাল মটরশুঁটি। কিন্তু বিশেষঙ্গরা বলছেন আগামী কিছু বছরের মধ্যে স্পেনে এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একইভাবে আমেরিকার আদিবাসীদের হাজার বছরের মেপল সিরাপ তৈরির প্রথা এখন বিপন্ন, কারণ তাপমাত্রা বাড়ায় মেপল গাছের সংখ্যা ও গুণমান কমছে। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কেবল রাস্তা বা নদী ভাঙনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা আমাদের স্মৃতি, সংস্কৃতি ও স্বাদের জগৎকেও পাল্টে দিচ্ছে। খাবার শুধু শরীর নয়, মনেরও আহার। তাই এর পরিবর্তন মানে একটি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া।