সুবর্ণপ্রতিম গিরি

মরা মরা করতে করতে কখন যে রাম রাম হয়ে যায় কে বলতে পারে। ছোটবেলায় শিবভক্ত হিসাবে পালন করেছি সব ব্রত, উপাচার। শিব ঠাকুরের সঙ্গে ছিল বন্ধুত্ব। পার্বতী শিবকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতেন সেই ছোটবেলা থেকে। শিব-পার্বতীর বিয়ে হোক চাইতেন সব দেবদেবীরাও। পার্বতীর কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে দেবতারা কন্দর্পকে শিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন। শিব সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ও তৃতীয় নেত্র দিয়ে তাঁকে ভস্ম করে দেন। কিন্তু শিবকে যে স্বামীরূপে মেনে যাপন শুরু করেছিলেন পার্বতী। তাই শিবকে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁর তপস্যার জোরে চারিদিকে হাহাকার শুরু হয়েছিল। বড় বড় পর্বতের ভিতও নড়ে গিয়েছিল। তখন শিব নিজের ধ্যান থেকে উঠেছিলেন এবং পার্বতীকে বলেছিলেন যে তিনি যেন কোনও যুবরাজের সঙ্গে বিয়ে করে নেন। কারণ শিবের সঙ্গে বসবাস করা সহজ নয়। কিন্তু হিমালয় কন্যা পার্বতী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি শিব ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেন না। পার্বতীর ভালোবাসা দেখে মহাদেব তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হন।  শিব যখন পার্বতীকে বিয়ে করতে যান, তখন তাঁর সঙ্গে ডাকিনি, ভূত-প্রেত, পেত্নী ছিল। ডাকিনি ও পেত্নীরা শিবকে ভস্ম দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন ও হাড়ের মালা পরিয়েছিলেন। আসলে শিবকে জানার সঙ্গে সঙ্গে শঠে শাঠং এই কাহিনী জানার সূত্রে দুর্গার সঙ্গে সম্পর্ক। আর তারপর তো প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে…’!

প্রেমের ক্ষেত্রে এর চেয়ে অমোঘ সত্যি বোধহয় আর কিছু হয় না। দুর্গার সামনে প্রেম প্রেম ভাব করে দাঁড়াতেই মনে এল লাহা বাড়ির পুজোর কথা। ছদ্মবেশ ধরে যদি কখনও শিব-সকাশ ছেড়ে সে আমার কাছে আসে, চিনতে পারবো তো? বিসর্জন শেষে বাড়ি ফিরে স্নান করছিলেন বাড়ির কর্তা। কলকাতার অন্যতম সেরা বনেদি বাড়ির পুজো বলে কথা! বিসর্জনের ঝকমারি তো কম নয়। বাড়ির উঠোনের কলঘরে স্নান সারছিলেন কর্তা দুর্গাচরণ লাহা। কিন্তু শান্তিতে স্নান করার জো আছে! সমানে এক বালিকা কোত্থেকে এসে সমানে ভিক্ষা চেয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে তাকে তাড়িয়ে দিলেন দুর্গাচরণ। কিছু পরেই কেমন যেন মনে হল তাঁর। স্নান মাঝপথে রেখেই খোঁজ করলেন বালিকার। কিছু ভিক্ষা দেবেন বলে। কোথাও দেখতে পেলেন না। বাড়ির সদর দ্বার হাট করে খোলা। দুর্গাচরণ নিশ্চিত‚ দরজা বন্ধ ছিল এবং ওই বালিকার পক্ষে একা অতবড় দরজা খোলা অসম্ভব। বাড়ির কোনও লোক‚ চাকরবাকর‚ কেউ বলতে পারল না বালিকাটি কোথায় গেল, কেউ তাকে দেখেনি। দুর্গাচরণ উপলব্ধি করলেন‚ ওই বালিকা আর কেউ নয়‚ স্বয়ং মা দুর্গা। তিনি হায় হায় করে উঠলেন। মা দুর্গা তাঁকে দেখা দিয়েছিলেন ভিখারিণী বালিকা রূপে। তিনি কেন তাঁকে বিমুখ করলেন? লাহা পরিবারের এই কর্তার অনুতাপ জীবনে যায়নি। তারপর থেকে শুরু হল এই পরিবারের দুর্গাপুজোর এক নতুন নিয়ম। বিসর্জনের সময় বন্ধ থাকে বাড়ির সব দরজা এবং জানালা। প্রধান দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা। তারপর বন্ধ হয়ে যায় সেই দ্বার। বাড়ি ফিরে কর্তা সদর দরজার বাইরে থেকে তিনবার চেঁচিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘মা কি আছেন বাড়ির ভিতরে?’ গৃহকর্ত্রী আড়াল থেকে উত্তর দেন‚ পরিবারিক দেবী ফিরে গেছেন ঠাকুরঘরে, আর মা দুর্গা রওনা হয়েছেন কৈলাসের পথে। এই উত্তর পেয়ে গৃহকর্তা প্রবেশ করেন বাড়িতে।

কলেজে একবার বিচ্ছিরি রেজাল্ট করলাম। আর তখন রেজাল্ট বেরতো ঠিক পুজোর আগে আগে। ইচ্ছে ছিল এবার সরাসরি প্রস্তাব। প্রেমিক হয়ে একটা হেস্তনেস্ত করতে হবেই। বলতেই হবে, যদি ভালোবাসিস তা হলে যেন…। অষ্টমীর অঞ্জলিতে আমি ঠাকুরের সামনে হাতজোড় করে শুধু বলতে পারলাম ‘সবই তো জানো, বাকিটা দেখে নিও’। দেখেছি, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু…। তবে তারপরে কবে থেকে যে ভগবানের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ঘুচে গেল ভেবে দেখিনি। হয়তো জীবনে আর বিশেষ কিছু পাওয়ার নেই। উচ্চাশা কোনওকালেই ছিল না, সেটাই তো সবচেয়ে বড় কারণ হয় ভগবানের সামনে হাতজোড় করে থাকার। ‘পক্ককেশ’ বয়সে ভগবানকে নতুন করে বোঝার চেষ্টা করিনি আর। কারণ এদিক ওদিক বিষয়ে নিজেকে এতবেশি করে উদাসীন করে ফেলেছি, কেমন একটা সাধু সাধু ভাব মনে লালন করছি। আর তখনই এল সুযোগ। সাধুসঙ্গের সুযোগ। পুরো বিষয়টি জারিত করতে কতকাল লাগবে জানি না। কিন্তু সাধু সম্পর্কে একটা প্রাথমিক অভিজ্ঞতা হল। ভুল বা ঠিক জানি না। সাধু মানে যাঁর সঙ্গে কথা বললে ভগবানের সম্বন্ধে স্ফুরণ হয়, যদি সঙ্গ কর তবে তার মূল‍্য তুমি বুঝতে পারবে। ভগবানের পথের পথিককে সাধু বলে। তিনি ঈশ্বর-পিয়াসী। এই পার্থিব জগতের যা কিছু আমরা অত‍্যন্ত অমূল‍্য সম্পদ বলে মনে করে আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরি, সাধুর অভিজ্ঞতায় তার কোনও মূল্য নেই। এটাও মনে হচ্ছে, সাধুসঙ্গ বলতে শুধুমাত্র কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে বোঝায় না, সাধুর সান্নিধ্য লাভ করে তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করাই হল সাধুসঙ্গ। আর কপালগুণে সেরকম এক সাধুর সংস্পর্শে এসেছিলাম, যাঁকে দেখলে মন শান্ত হয়, মনে বসতে চায় একান্তে, নিজেকে উপলব্ধি করার স্পৃহা জন্মায়। তিনি নারায়ণচরণ স্বামী। তিনি দৃশ্যমান আলো বা আভায় উজ্জ্বল। সেই আলোয় আলোকিত হওয়ার সাধ‌্য আমার নেই জানি, কিন্তু যদি সেই আলোর সামান‌্যতমও মনের তমাশা দূর করতে পারে তাহলেই আমি বর্তে যাবো। ঠিক যেমন পথের পাঁচালীতে দুর্গা নামে দেবীর কথাকে ছাপিয়ে গিয়েছে এক গরিবস্য গরিব সর্বজয়ার অশান্ত, চঞ্চল প্রকৃতিকন্যা দুর্গার কথা। এই উপন্যাসে খুবই সম্ভব ছিল ঘটা করে দুর্গাপূজার উৎসব দেখানো। কিন্তু ইন্দির ঠাকরুনের করুণ জীবন ও মৃত্যু দিয়ে বিভূতি যে বিষাদের সুরে পথের পাঁচালী গাওয়া শুরু করলেন, অভাবের যে টানাপোড়েন চলে হরিহর-সর্বজয়ার সংসারে, সেখানে তো উৎসবের আলো-বাদ্যি বেমানান। তাই স্বর্গের দেবীকে আড়ালে রেখে এক দুঃখিনী বালিকাকে সেই আসনে বসালেন লেখক। অভাগিনী এই মনুষ্যকন্যাই তো নিশ্চিন্দিপুরের স্মৃতির বেদিতে চির অধিষ্ঠিতা। পথের পাঁচালীর প্রধান বিসর্জনের ব্যথা তার প্রয়াণেই সৃষ্ট। ছোট ভাই অপুকে যে প্রকৃতি ও বনাঞ্চল চিনিয়েছিল, আস্বাদন দিয়েছিল গ্রাম্য প্রকৃতির সৌন্দর্যের, পৃথিবীর পথে যে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল বালক অপুকে, অপু যাকে কখনও ভুলতে পারেনি, অথচ যার মুখ আবছায়া হয়ে গিয়েছিল পরে। এই সাধুসঙ্গের পর এসে মনে হয়, শরতের কাশবনের ভেতর দিয়ে যে কিশোরী দৌড়ে যায়, সেই দুর্গাই তো পথের পাঁচালীর দুঃখের পূজার প্রধান দেবী। সেই-ই এই আখ্যানের শরৎদুহিতা, অকালবোধনের পর অকালমৃত্যুতে যার বিসর্জন। সেই তো আমাদের ‘গডেস অব স্মল থিংস’!

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version