সুবর্ণপ্রতিম গিরি

আমাদের জীবন নাগরদোলার মতো। এই আকাশে তো এই ভূমিস্পর্শ। মজা করে লোকে বলে, এটাই তো জীবন কালী দা। হাল্কা জ্ঞান দিই। নাগরদোলার উপরে যখন থাকবে, ওই উপর থেকে নীচে থাকা লোকজনের জন্য হাত নাড়বে, ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে দেবে। তারা উল্লসিত হবে, কারণ তাঁরাও উপরে উঠতে চায়, শীর্ষে ওঠা মানুষটার সঙ্গে লেপ্টে থাকতে চায়। মনে রাখবে, জীবনটা এখানেই শেষ নয়। আর একটা দিকও আছে। সেটাই হয়তো শিক্ষার দিক। সেটা হল নাগরদোলায় যখন তুমি একেবারে নীচের সিটে বসে আছো। তখন কিন্তু তুমি নজরের বাইরে। কারণ সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে। নীচের সিটে তুমি একা এবং অনভিপ্রেত। নীচের সিটে বসে ঘাবড়ে গেলেই সাড়ে সাব্বোনাশ।

আমাদের বকুলতলায় ভিড় জমেছে, বসেছে মেলা। সেই মানব মেলায় রঙিন আইসক্রিম-গাড়ি বলে ভুল করে অনেকে। সময় দক্ষ ছদ্মবেশী। দ্রুত ছোটে। পেরিয়ে যায় বায়না ধরিয়ে। বাচ্চা মেয়েটি তবু ফ্রক দুলিয়ে ছুটে যাবে সেদিকেই। চোখে চশমা। মেয়ের পিছু পিছু মা-ও এগোয় কয়েক পা। তারপর ফিরে আসে। পছন্দের আইসক্রিম পেল না বুঝি! নাকি তার কচি গলার ডাক শুনতেই পায়নি দ্রুতগামী আইসক্রিমওলা, কে জানে! কে কখন কার ডাক যে শুনতে পায় না; মানুষ তবু মানুষকেই ডেকে ডেকে ফেরে; ডাকবেও। বাচ্চাটা শুধু জানবে, ডেকে সাড়া না-পাওয়া এক প্রাচীন অসুখ। আজও তার ওষুধ আবিষ্কার করেনি কেউ! ভেবেই হয়তো সে একখানা আঙুল ঠেকায় চিবুকে। একটা গোটা শহর তখন বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকাতে পারে না, লজ্জায়; চোখ নামিয়ে নেয়।

স্টার্ট দিতে গিয়ে অটো থমকায়। সিগনাল ছেড়ে দিলে বাঁক ঘোরার আগে বাসও খানিক ইতস্তত। মেয়েটি তখন মায়ের দিকে দেখে একবার। আর একবার তাকায় দূরে, বিপন্ন এক মেনে-নেওয়া রাস্তায় চলে যাওয়া আইসক্রিম-গাড়ির দিকে। দেখে, একটা আস্ত খরগোশ লাফিয়ে লাফিয়ে শুধু এগিয়ে চলেছে দৌড়ে। তার চোখে ঘুম নেই। ক্লান্ত সেই শহর এই মুহূর্তটির কাছে যেন হেরেই যায়। শ্লথ পায়ে এগিয়ে এসে দু’দণ্ড দাঁড়ায় বাচ্চাটির পাশে। শুধু এই কথা বলবে বলে, সব দৌড়ের গল্পে কচ্ছপ তো জেতে না; তবু হেরে-যাওয়া মুহূর্তে সকলেই খানিক গল্প হয়ে ওঠে। স্মৃতি আসলে মোকাম। স্মৃতি অস্ত্র। সম্বল। পুঁজি। স্মৃতি এক রকমের ভাষা। আশ্রয়। স্মৃতি ভিটে। স্মৃতিই সম্ভবত বাস্তুসাপ। যার স্মৃতি নেই, সে মানুষ এক অর্থে উচ্ছিন্ন। অ্যাবসার্ড। এ পৃথিবীতে মানুষ কখন এলিয়েন হয়ে ওঠে? কামু বলবেন, একজন স্ট্রেঞ্জার হয়ে ওঠা মানুষের প্রস্থান ঠেকানো যায় না, ‘since he is deprived of the memory of a lost home or the hope of a promised land.’ অর্থাৎ যার ভিত্তি গেছে টলে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যার আশামাত্র আর নেই। জীবনের সঙ্গে মানুষের এই যে ডিভোর্স, যেমন একজন অভিনেতার সঙ্গে সেটের, কামু তাকেই অ্যাবসার্ড বলেন। এই অ্যাবসার্ডিটি ব্যক্তি মানুষের নিজের খামখেয়াল নয়। সময়ের কলে পড়েই কেউ একজন হয়ে ওঠেন অ্যাবসার্ড ম্যান। এলিয়েন বা স্ট্রেঞ্জার যা-ই হোন না কেন, আসলে তা আত্মগোপন। এই জীবনে তিনি তখন ঢুকে পড়েন পাতালে। আর সেই পাতাল থেকে লেখা হয় চিরকুট।

নাগরদোলার নীচের সিটে বসে থাকা অ্যাবসার্ড ম্যান প্রত্যেকে হয়তো আমরা, তবু যে প্রস্থান থেকে বেঁচে যাওয়া, তা শুধু স্মৃতির ভিত্তি থাকে বলে। এই সূত্রেই স্মৃতি আত্মচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আর সেই স্মৃতিই বলে দেয় ছাড়তে জানতে হয়। সব কিছু আবেগে চলে না, কথাটা বুঝতে ও মানতে জানতে হয়। তুমি পর-আপনের মেল বন্ধন ঘটাবে ভাবলেই তো হবে না বস। জীবনে কিছু আবেগ হঠাৎ করেই মুক্তি চেয়ে গো হারা হারে। ভীষণ রকম কষ্ট হলেও সেটা মেনে নেওয়াই হল জীবন। হয়তো অনেকের আখ্যানে সেটাই পেশাদারিত্ব। আসলে মনে হয়, একমাত্র আবেগই মুক্তির পথ চিনিয়ে দেয়। কারণ আবেগ বদ্ধ ও মিথ্যার ঘরে থাকতে পারে না। সেটাই তার রাজকীয় মেজাজ।

ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা যাক। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সবসময়েই রাজকীয়। যেমন তাদের চলন, তেমনই বলন থুড়ি গর্জন। জিম করবেট তাঁর শিকার কাহিনীতে বলেছিলেন, নিঃস্তব্ধ জঙ্গলে ঘাসের উপর দিয়ে যখন পা টিপে টিপে কোনও শিকারকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় হলুদ-কালো ডোরাকাটারা তখন তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হয় দেখার মতো। রাজকীয় সে চলন। শরীরের প্রতিটি পেশিতে যেন ঢেউ খেলে যায়। এই রাজকীয় মেজাজই তাদের খুব শক্তিশালী করে তোলে। এদের সঙ্গে মশকরা করতে গেলে বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে। এরা কখনওই পোষ মানে না। এই বাঘেদের অনেক সঙ্গিনী থাকে। এলাকা দখলের লড়াইতে এরাই বিজয়ী হয়। তাই এদের পরাক্রম দেখে প্রেমে পড়ে বাঘিনীরা। ঘন ঘন সঙ্গম করতে পছন্দ করে এই বাঘেরা। গবেষকরা বলছেন, এরা রাজার মতো থাকতে ভালবাসে। জীবনের নাগরদোলায় যখন একেবারে নীচের সিটে বসে থাকবে, তখন মুখ গুঁজে বসে না থেকে অপেক্ষা করবে উড়ানের। আর তা যখন হবে, মেজাজটা যেন রাজকীয় হয়। একেবারে রয়‌্যাল বেঙ্গলের মতো।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version