সুরাইয়া সুলতানা

সেই আদিম যুগ থেকে মানুষ যখন সভ্যতার পথে এগলো তখন প্রথমে গাছের পাতা, ছাল কিম্বা পশুর চামড়া গায়ে তুলে নিয়েছিল। তারপর থেকে পোশাক নিয়ে যুগে যুগে বিস্তর গবেষণা চলেছে। শিল্প বিপ্লবের সময় প্রথমেই বস্ত্র শিল্পের কথা এসেছিল। এমনকি ব্রিটিশ শাসিত ভারতে রাজনীতির ক্ষেত্রে পোশাককে ঘিরে স্বদেশী আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ স্বরূপ দেশী চরকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন গান্ধীজী। সারা ভারতে মেয়েদের প্রধান পোশাক ছিল শাড়ী। এক সময়ে সেই শাড়ী তাদের কাছে হয়ে উঠতো সময় অতিবাহিত করার বা অবসরের উপকরণ। কাপড় রঙিন করা, তাতে নানা নক্সা তৈরি করে মনের শৈল্পিক পরিচয় দিত। ফুল পাতার রস, রঙ বা ছাপ দিয়ে তারা রাঙিয়ে নিত নিজের পোশাক। আর তার সঙ্গে মিলিয়ে তারা ব্যবহার করতো নানা রকমারি গয়না। লোহার, পিতলের, সোনা কিম্বা রুপোর। কানবালা, ঝুমকো, চোকার, হার, সীতাহার, টিকলি, ঝুমার, টায়রা, চুড়ি, চুড়, কঙ্কন, মান্তাসা, কোমরবন্ধ, নুপুর বা মল, ভাঙ্কি, হাতফুল, নাকছাবি ইত্যাদি। সেগুলিতেও থাকতো আগুন জ্বালিয়ে হাতের সাহায্যে বানানো নানা কারুকাজ। এই সমস্ত গয়নায় রাজ্যভেদে নকশার বদল হয়েছে। এমনকি আদিবাসী মহিলারাও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে ফুল বা পাতা দিয়ে এই সমস্ত গয়না বানিয়ে নিজেদের সাজিয়ে তোলে।

কিন্তু ভারতীয় নারীর প্রধান পোশাক হিসেবে কাঁচুলি আর শাড়ী সর্বস্থানে বিদ্যমান ছিল। তারপর মোঘল পাঠান সহ অন্যান্য বিদেশি শক্তির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সালোয়ার কামিজ, ঘাগরা চোলি, সারারা, গারারা, চুড়িদার ইত্যাদি মেয়েদের পোশাক ভারতীয় শাড়ীর সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে। তারপর পশ্চিমী শক্তির অনুপ্রবেশের ফলে শার্ট প্যান্ট, স্কার্ট, ফ্রক, গাউন ইত্যাদি চলে আসে। আসামের দিকে শাড়ি, স্কার্ট আর ওড়নার ফিউশন হয়ে তৈরি হয়েছে মেখলা নামক আঞ্চলিক পোশাক। সবকিছুতেই দেখা গিয়েছে আঁকা, নানা নকশা, ফুল পাতা কিংবা পশুপাখির ছবি। থাকে মন্দিরের চূড়া বা দেবদেবীর সাংকেতিক চিহ্নের নকশাও। কিছু শাড়ি এখনো সমান জনপ্রিয় যেমন কাঁথা স্টিচ যা নকশীকাঁথা মনে করায়, কলামকারি ফুল পাতা প্রকৃতির নকশা, বালুচরি পশুপাখি কিংবা ওড়িষা বা দক্ষিণ ভারতের শাড়িতে টেম্পল ডিজাইন। কিছু শাড়িতে জনজীবনের কাহিনীও তুলে ধরা হয়। এগুলি সেই পুরনো দিনের পোশাক শিল্পেরই প্রতিরূপ। যেমন আমরা দেখি গুহার উপর বা পুরোনো মন্দিরের উপর আদিম মানুষ খোদাই করে বানিয়েছে নানা শৈল্পিক কারুকাজ। তাই প্রস্তর যুগ থেকেই মানুষ শিল্পের পূজারী। আর এই শিল্পই অবসর যাপনের উত্তম পন্থা।

ভারতবর্ষে বিভিন্ন বিদেশী শক্তি আর দর্শনের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নানা সাজ পোশাক ও প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহারের ভিন্নতা দেখা গিয়েছে আর মানুষ তাকে সাদরে গ্রহন করায় সেগুলি ভারতীয় সাজ পোশাকের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। এখনকার সেই সব আধুনিক পোশাকেও দিয়েছে ভারতীয় শিল্পকলার ছাপ। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নৃত্য শিল্পের জন্য আবার আলাদা আলাদা পোশাক বা গয়না ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সেখানে সমস্ত গয়নার সঙ্গে কোথাও মাথায় মুকুট ব্যবহার হয়, আবার চাঁদ, তারাও ব্যবহৃত হয় ভারতনাট্যম নৃত্যের ক্ষেত্রে। সেই সব গয়নাতে নানা কারুকাজ, রঙিন পাথর বসিয়ে ডিজাইন করা হত। এই সবের হাত ধরে ভারতের নানা প্রান্তে গহনা শিল্পের স্থাপন হয়েছে। আর কত্থক নৃত্যের ক্ষেত্রে চুড়িদার আর ঘের দেওয়া ফ্রক ও মাথায় ওড়না দেওয়া হয়। কত্থক নাচ মোঘল আমলে বেশি প্রচার পায় তাওয়াফের ঘরানা ধরে। তাই এই নাচের পোশাক বা সাজ সরঞ্জামে কিছুটা মুসলিমদের সাজ আর গয়নার প্রভাব লক্ষনীয়। কত্থক নাচের পোশাক আর গয়নাতেও থাকতো নানা ডিজাইন। মূলত ফুল পাতার নকশা আর দামী পাথর বা সোনা রুপোর কাজ। মাথায় টিকলির সঙ্গে ছপকা বা ঝুমার ব্যবহার করা হয়। পায়ে ঘুঙুর দেওয়া মল বা নুপুর, অঙ্গুরী ইত্যাদি নৃত্য সাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

সব কিছুতেই সেই আগুন জ্বালিয়ে ধাতু গলিয়ে নকশা দেওয়ার চল চলে আসছে। মানুষ যখন থেকে আগুন জ্বালাতে শিখলো আর ধাতুর ব্যবহার শিখলো আধুনিক যুগেই প্রবেশ করলো বলা যায়। বাংলায় পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্যে দেখা যায় মাথায় বিরাট আকারের মুকুট, মুখে রঙ ব্যবহার করে মুখোশ তৈরির সাজ। এই মুখোশ কিছুটা ঠাকুর দেবতাদের মাথার মুকুটকে নকল করে তৈরি হয়। ঠাকুর দেবতার রুপ যে অঞ্চলের মানুষ যেভাবে কল্পনা করতে পেরেছে মনের লালিমা মাখিয়ে সাজিয়ে নিয়েছে। যুদ্ধ নৃত্য বলে পরিচিত এই নাচ আদিবাসী নৃত্যের অন্তর্ভুক্ত। এসবই ভারতের নানা প্রান্তের পোশাক আর সাজের রকম ফের। প্রায় লৌহ প্রস্তর যুগ থেকেই মেয়েদের সাজে গয়না, চোখে কাজল বা মুখেও রঙের ব্যবহার এবং প্রসাধনী একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মানুষ নিজেকে চিরকাল ভালোবেসেছে আর ভালোবাসা পাওয়ার আশা করেছে। এই ভালো বাসাই পৃথিবীতে চিরন্তন। সেই ভালোবাসাই নিজের চোখে কাজল দিয়ে আরও টানা টানা, ঠোঁট পান খেয়ে রঙিন করে নিতো। নিজেকে সুন্দর দেখার অর্থই হলো পৃথিবীকে সুন্দর দেখতে পারা। এই পৃথিবীকে সাজাতে, বাসযোগ্য করতে মানুষের ভূমিকাই তো সর্বাধিক। তাই শুধু সাজানোই নয় অন্য কাউকে মোহিত করার তাদিগ অনুভব করে, প্রশংসার দাবী করে।

এরপর আসে সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার ও রুপটানের জন্য বিভিন্ন দ্রব্যের বব্যবহার। সাদাটে মুলতানি মাটি, লাল মাটি, হলুদ, মেহেন্দি সহ নানা পাতার রস, মেথি বাটা, গোলাপজল, দুধ ইত্যাদি দিয়ে আজও মেয়েরা উপটান বানিয়ে লাগান। যা বিয়ের সময় এক অনুষ্ঠান হিসেবে এখনো সমান জনপ্রিয়। মেহেন্দি দিয়ে হাতে পায়ে ডিজাইন করাও বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়ে ছাড়াও মুসলিম মেয়েরা ঈদ বা রোজা রাখার দিনগুলিতেও হাতে মেহেন্দি দিয়ে ফুল, পাতার কল্কা, কিম্বা গুম্বুজের নকশা বানিয়ে রাঙিয়ে নেয়। আজকাল যে কোনো মেলায় গেলেও মেহেন্দি দিয়ে হাতে নকশা করে সেজে মেয়েরা আনন্দিত হয়। হয়ত ভালোবাসার মানুষটির প্রশংসা পেতে আর প্রজাপতির মতো নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতেই এই প্রয়াস।

মুসলমান সমাজে শুক্রবারকে খুব পবিত্র মানা হয়। এই দিনটিকে সপ্তাহের ছোট্ট ঈদ বলেই অনেকে পালন করেন। ভালো রান্না করা, মিষ্টিমুখ করা, পরিস্কার বা নতুন কাপড় পরা, আতর লাগানো, মানুষের সঙ্গে, আপনজনের সঙ্গে মিলনের দিন এই শুক্রবার। ঈদ আর কিছুই নয় মানুষের সাথে মানুষের মিলন, অনন্দ করা, নিজেকে, পরিবারকে, প্রতিবেশীকে ভালো রাখা, সদ্ভাবের বার্তা দেওয়া। সেই সুবাদে প্রত্যেক শুক্রবার মুসলিম পরিবারের ছেলেরা মসজিদে একত্রিত হয়ে থাকেন। মৌলভী সদ্ভাবের বার্তা দিয়ে থাকেন। সামাজিক সমস্যা সমাধানের বার্তা দিয়ে থাকেন সমাজের প্রগতির উদ্দেশ্যে। এই প্রচলন প্রফেট মহম্মদ শুরু করেছিলেন। সেই সময় থেকেই তিনি ভালো কাজের উদ্দেশ্যে তার অনুসারী বা সাহাবাদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে সুবার্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। সেই প্রচলিত সংস্কৃতির এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ দেশ অঞ্চল ভিত্তিক তার অন্য রুপ দিতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু মূল বার্তা সেই মিলন বা ঈদ।

(প্রথম পর্ব শেষ)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version