সৈয়দা খুশতারা বানু ওরফে বানু মুশতাক তাঁর ছোটগল্প সংকলন “হার্ট ল্যাম্প”-এর জন্য এ বছর আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতেছেন। তিনি কন্নড় ভাষার সাহিত্যের প্রথম লেখক যিনি অনূদিত কথাসাহিত্যের জন্য এই সম্মানিত সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।বানু মুশতাক তাঁর অনুবাদক দীপা ভাস্তির সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কারের সম্মান অর্জন করেছেন, অনুবাদক দীপা ভাস্তি বানু মুশতাকের গল্পগুলি বেছে নিতেও সাহায্য করেছিলেন। এর আগে বানু মুস্তাক কর্ণাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (২০০৪) সহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন। উল্লেখ্য, তাঁর লেখা গল্প অবলম্বনে গিরিশ কাসারভাল্লি পরিচালিত কন্নড় চলচ্চিত্র ‘হাসিনা’ অসংখ্য জাতীয় পুরষ্কার জিতেছে এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু এই প্রথম তাঁর সাহিত্য ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হল। তিনি কবি ও লেখক পি. লঙ্কেশ (গৌরী লঙ্কেশের পিতা) সম্পাদিত “লঙ্কেশ পত্রিকা”তে ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, একজন রিপোর্টার হিসাবেও কাজ করেছিলেন। কয়েক বছর আগে নিউ এজ.কম পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি সাক্ষাতকার থেকে তাঁর লেখক জীবনের কথা জানা যায়।

১৯৮১ সালে তাঁর তৃতীয় কন্যা সন্তানের জন্মানোর পর তিনি খুব হতাশায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। তাঁর সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং তাঁকে উৎসাহিত করতে তাঁর স্বামী তাঁকে প্রচুর বই এবং ম্যাগাজিন এনে দেন। সেই বই ও ম্যাগাজিনগুলি দেখতে দেখতে একটি ম্যাগাজিন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষন করে। সেই ম্যাগাজিনটি ছিল ‘লঙ্কেশ পাত্রিকা’। কন্নড় ভাষায় প্রকাশিত প্রগতিশীল এবং ধর্মনিরপেক্ষ সেই ম্যাগাজিনের পাতায় তিনি বিজাপুরের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নাজমা ভাঙি নামে একজন মুসলিম মহিলার সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন দেখতে পান। সেই সময় তাঁর শহরের মৌলভিরা মুসলিম মহিলাদের প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ করেছিল, কিন্তু এই সাহসী মহিলা সেই নিষেধাঙ্গা অস্বীকার করে সিনেমা দেখতে চলে যান। ক্ষুব্ধ মৌলভিরা এবং শহরের অন্যান্য পুরুষরাও তাঁর এই আচরণকে অবাধ্যতা মনে করে তাঁর বিরুদ্ধে হইচই শুরু করে। তাকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয়। ইতিমধ্যে বানু মুশতাক তাঁর হতাশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে অনেকটাই বেড়িয়ে এসেছেন এবং শিক্ষিকা নাজমা ভাঙির সঙ্গে যে ধরণের আচরণ করা হচ্ছিল তাতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য একটি প্রবন্ধ লিখে ‘লঙ্কেশ পত্রিকা’য় পাঠিয়ে দেন। ওই প্রবন্ধে তিনি মৌলভি তথা পুরুষদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন যে, যদি মুসলিম মহিলাদের সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে তারা মহিলাদের জন্য অন্য কোন ধরনের বিনোদনকে বৈধ বলে মনে করেন? তারা কি মনে করেন যে, মহিলারা আদৌ কোনো বিনোদন উপভোগ করার যোগ্য? তিনি এই প্রশ্নও রেখেছিলেন যে ইসলাম কি মহিলাদের বিনোদনের অনুমতি দিয়েছে? যদি সিনেমা দেখা, যেমনটি তারা দাবি করেছেন, মুসলিম মহিলাদের জন্য খারাপ, তাহলে কি মুসলিম পুরুষদের জন্যও একইভাবে খারাপ নাকি ভাল? তাহলে কেন কেবল মুসলিম মহিলাদের জন্য সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ আর কেনই বা মুসলিম পুরুষদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে? যদি সিনেমা অনৈতিকতা প্রচার করে, তাহলে অবশ্যই এটি পুরুষদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য যেমন এটি মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?

তিনি জানান, যদিও তিনি এর আগেও প্রবন্ধ এবং ছোটগল্প লিখতেন এবং সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে পাঠাতেন, কিন্তু সেগুলির কোনওটিই প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু লঙ্কেশ পত্রিকার সম্পাদক তাঁর ওই লেখাটি খুব পছন্দ করেছিলেন এবং সেটি প্রকাশ করেছিলেন। সেই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর ছড়িয়ে পড়ে। হাসানের মৌলভিরা এবং অন্যান্য লোকেরা এরপর বানু মুশতাকের উপর প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাঁরা বানু মুসতাকের বাবাকে তাঁদের বাড়ির পাশে একটি মসজিদে নিয়ে গিয়ে তাঁকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেন। অন্যদিকে ওই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই, ‘লঙ্কেশ পত্রিকা’ আমাকে তাঁকে হাসান জেলার জন্য তাদের প্রতিবেদক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই কাজের জন্য তাঁকে অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল, বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল। সেই সময় তিনি বহু অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন করেন, অনেক জায়গায় প্রচুর ঝুঁকিও ছিল, কিন্তু তিনি যেখানেই যেতেন সবসময় তাঁর সন্তানদের একজনকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতেন যাতে তারাও কিছু শিখতে পারে। বানু মুসতাক ‘লঙ্কেশ পত্রিকা’র সঙ্গে দশ বছর যুক্ত থেকে কাজ করেছিলেন পাশাপাশি অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কন্নড় সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিনের জন্যও লেখালেখি শুরু করতেন। তিনি প্রধানত নারী, মুসলিম, কৃষক এবং দলিতদের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক বিষয়গুলির উপর লেখালিখি করতেন। তিনি জানান, তাঁর কাজের জন্য তাঁর স্বামী কখনও তাঁর উপর বিরক্ত হননি বরং তিনি তাঁকে সবসময়েই উৎসাহিত করতেন। তাঁর কথা অনুযায়ী তিনি ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী বানু মুশতাকের অবিরাম সমর্থনের উৎস। যদিও এরপর তাঁর চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয় এবং সেই বিশাল পরিবার পরিচালনা করতে হয়েছিল, তবুও তিনি কখনই পারিবারিক দায় দায়িত্ব তাঁর সাহিত্য সাধনার পথে বাধা হতে দেননি।
