কলকাতা ব্যুরো: ইস্টার্ন কোল্ড ফিল্ড লিমিটেডের কাজোরা ও কুনোষ্টরিয়া কোলিয়ারি ঘিরেই বেআইনি কয়লার পাচার নিয়ে তদন্তে নামে সিবিআই। যদিও আসানসোলের কয়লা খনি এলাকায় বেআইনি কয়লার পাচার নতুন কিছু নয়।

ভিজিলান্স হানাতেই সূত্রপাত —

কিন্তু করোনা লকডাউনের মধ্যে অতর্কিতে মে মাসে ইসিএলের বিভিন্ন এলাকায় কয়লা তোলার লিজ দেওয়া এলাকায় তদন্তে যায় ভিজিলান্স ও ইসিএনএর টাস্ক ফোর্স। সেখানেই টিমের নজরে আসে বেআইনিভাবে বিশাল এলাকাজুড়ে বেআইনি খাদান চালানো হচ্ছে। এলাকায় সরেজমিনে খতিয়ে দেখার সময় ওই অফিসাররা বুঝতে পারেন, প্রচুর সংখ্যক গাড়ি, যন্ত্রপাতি এবং লোকজনকে এই বেআইনি পাচারে যুক্ত করা হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে কয়লা এবং গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে ওই দল। এমনকি তদন্তকারীরা দেখেন, বেআইনি ওয়ে ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে কংক্রিট দিয়ে, ফলে তারা স্পষ্ট বুঝতে পারেন দীর্ঘদিন ধরেই এই চক্র স্থায়ীভাবে বেআইনি কারবার চালাচ্ছে। যে বিপুল পরিমাণ বেআইনি কয়লার স্তুপ নজরে আসে, সেখান থেকেই এই চক্রের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রাথমিক সূত্রপাত হয়।

তোপসি ও লোছিপুরই ফাসালো —

সম্প্রতি বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সির কাছে খবর যাচ্ছিল, ইসিএলের কুনস্তরিয়া এলাকার তোপসি এবং কাজোরা কোলিয়ারির লচিপুর গ্রামে বেআইনি কয়লা খাদান চলছে। একদিকে ইসিএলের অফিসার থেকে শুরু করে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিআইএসএফের প্রত্যক্ষ মদতে কোটি কোটি টাকার বেআইনি কয়লার পাচার চলছে বলে অভিযোগ পান তদন্তকারীরা।

গত ৭ আগস্ট পাণ্ডবেশ্বর রেল সাইডিং এলাকায় হঠাৎই অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণে কয়লা বাজেয়াপ্ত করে ভিজিলান্স। সেই ঘটনায় আরো স্পষ্ট হয়, রেলওয়ে এলাকার মধ্যেই এমন বেআইনি কয়লা জমায়েতে বড় ভূমিকা রয়েছে রেলের এক শ্রেণীর অফিসারের। একশ্রেণীর কর্মী ও অফিসারের মাদতে বেআইনি কয়লা এনে জড়ো করা হয় রেল সাইডিংয়ে। ওই তল্লাশির পর একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, কোলিয়ারি এলাকায় এরিয়া সিকিউরিটি অফিসার এবং সিকিউরিটি ইন চার্জ এবং জেনারেল ম্যানেজার মদত না দিলে এমনটা হতে পারে না।

সর্ষের মধ্যেই বড় বড় ভূত —

এরপরেই আরো গভীরে নজরদারিতে নিশ্চিত হয়, মূলত ইসিএলের দুটি কোলিয়ারি এলাকাতেই এই বেআইনি খাদা নের রমরমা চলছে। কুনস্তরিয়া ও কাজোরা নিয়ে এবার মাঠে নামে সিবিআই। এরপর অমিত ধর কুনস্ত রিয়া এলাকার জেনারেল ম্যানেজার, যিনি বর্তমানে পাণ্ডবেশ্বর এলাকার জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে রয়েছেন এবং ধনঞ্জয় রাই ওই এলাকার সিকিউরিটি ইন্সপেক্টর নাম উঠে আসে। একই সঙ্গে উঠে আসে জয়েস চন্দ্র রাইয়ের নাম। তিনি আবার কাজোরার জেনারেল ম্যানেজার এবং সেখানকার সিকিউরিটি ইনচার্জ দেবাশীষ মুখার্জীকে অভিযুক্ত করা হয়। পাশাপাশি ইসিএলের চিফ অফ সিকিউরিটি তন্ময় দাসকে অভিযুক্ত করা হয় গোটা চক্রে মদ ত দেওয়ার অভিযোগে। এই দুটি এলাকাতেই লিজের জমিতে কোটি কোটি টাকার কয়লা বেআইনিভাবে পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ এর আরো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।

সিআইএসএফ আর রেলের বড় মদত —

এরপরই তদন্তকারীরা আরো তথ্যপ্রমাণ পান যেখানে দেখা যায় ইসিএলের বেআইনি কয়লা তোলার পরে সিআইএসএফ এর উদাসীনতায় ট্রাকে ট্রাকে তা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রেল ইয়ার্ডে। আর গোটা চক্রে অনুপ মাঝি বা লালাকে পাচারে মদতের অভিযোগ ওঠে এই গোটা সরকারি আধিকারিকদের চক্রের বিরুদ্ধে। এরপরেই সকলের নামে এফআইআর করা হয় সিবিআইয়ের তরফে শুক্রবার সন্ধ্যায়।

বাড়িতে সিবিআই, মৃত্যু অফিসারের —

এরইমধ্যে এফআইআর-এ অভিযুক্তদের মধ্যে কুনস্থরিয়ার স্থানীয় এলাকার সিকিউরিটি ইনচার্জ ধনঞ্জয় রাই এর বাড়িতে শনিবার সকালে সিবিআই তল্লাশির মধ্যেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যদিও তার বাড়ি থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা সিবিআই উদ্ধার করেছে বলে জানা গিয়েছে। ধৃতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছাড়াও ইসিএল, সিআইএসএফ এবং ভারতীয় রেলের অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে সিবিআই।

শুরু আয়কর দপ্তরের লালায় হানায় —

এর আগে গত ৪ নভেম্বর আয়কর দপ্তর হঠাৎই হানা দিয়েছিল আসানসোল, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, রানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। সিবিআইয়ের এফআইআর-এ নাম ওঠা অনুপ মাঝির পুরুলিয়ার বাড়ি, রিসোর্ট এবং তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ লোকের বাড়িতে সেদিন হানা দিয়ে আয়কর দপ্তর নগদ প্রায় সাত কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করে। আয়কর দপ্তর সূত্রে খবর, অনুপ মাঝিকে এই কয়লা পাচারে সরকারি অফিসাররা ছাড়াও আরো কারা বা কোন প্রভাবশালীদের থেকে মদ ত পাবার জন্য অনুপ মাজি তাদের নিয়মিত টাকা পাঠাত তার বেশ কিছু নথি সেদিন বাজেয়াপ্ত করেছে বলে সূত্রের খবর।

পলিটিক্যাল প্রেসার গেম?

আর আয়কর দপ্তর এর সেই হানার পরেই সিবিআই তাদের সঙ্গে প্রাথমিক কথা বার্তার পর শুক্রবার এই তদন্ত হাতে নেয়। আর শনিবার সকাল থেকে শুরু হয় লাগাতার তল্লাশি। বিধানসভা ভোটের আগে এমন তল্লাশি বা তদন্ত নিয়ে খুব একটা ভরসা নেই কয়লা খনি এলাকার বাসিন্দাদের। তাদের কাছে এটা একটা পলিটিক্যাল প্রেসার গেম ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই চক্রের পিছনে ধাক্কা প্রভাবশালী বিরোধীদের চাপে রাখা আর ভোটের বাজারে তাদের হাতে কালো টাকা পৌঁছে যাওয়া বন্ধ করতেই হঠাৎ এমন হানা কি না, তা নিয়ে জল্পনা চলছে কয়লা খনি এলাকায়। ফলে আগামী বিধানসভা ভোটের পরেই এই তদন্ত হিম ঘরে চলে যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের মনে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version