গত শতকের চল্লিশের দশক নয় কিংবা সত্তরের দশকও নয়। তারচেয়েওবহুবছরআগেরঘটনা। প্রায় ১৭০ বছর আগে একটি বইয়ের কারণে গ্রামেরকিছু মানুষ একটি স্কুলবাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতেচাইল।ভাবতেঅবাকলাগেঅথচএমনটাইঘটেছিল।সময় কাল ১৮৫১,ঘটনা স্থলতৎকালীন বাংলার ঢাকা জেলার বিক্রমপুর। একটি বইয়ের জন্য সেখানকার মানুষ এমন ক্ষেপেগেল যে আস্ত একখানা স্কুলবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল। কি এমন বই যে তাঁরা এতখানি ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

বইটির নাম ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’। লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত। একদিকেসদ্য প্রকাশিত বইটি পড়ে বিক্রমপুরের কালীপাড়া স্কুলের এক দল ছাত্র মুগ্ধ হল, অন্যদিকে আরেক দল মানুষ উঠল ক্ষেপে। তার মানে বইটির বিষয়বস্তুই হল মুল কারণ।বইতে এমন কথা লেখা আছে যা পড়ে ছাত্রের দল মুগ্ধ আর তার প্রভাবে তৈরি হয়েছিল সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি।

১৭০ বছর আগে লেখা ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’-এ লেখক লিখেছিলেন: বিবাহের আগে হবু দম্পতি পরস্পরের সঙ্গে ভাল ভাবে আলাপ-পরিচয় করে নেবে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য যেন বেশি না থাকে। সংসারে নারী ও পুরুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব সমান। যদি স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে এবং সমাধানের কোনও পথ খুঁজে না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ কাম্য।

ধরে নেওয়াই যায় যে এমন কথা স্কুল-কলেজের ছাত্রেরা তার আগে শোনেননি কিংবা পড়ে্ননি। স্বভাবতই প্রথম পাঠেই তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। কেবল মুগ্ধ নয়, ঢাকার বিক্রমপুরের কালীপাড়া স্কুলের কিছু ছাত্র সভা করে প্রতিজ্ঞা পত্রে স্বাক্ষর করলেন: আমরা এই পুস্তকে লিখিত বিবাহাদির নিয়ম সকল অবলম্বন করিব।এর পরেই তোলপাড় পড়ে গেলচারদিকে।আর তাতেই ক্ষেপে উঠল ধর্মান্ধ রক্ষণশীল মানুষের দল। তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন তাঁরা। খুব দ্রুত তাঁরাঠিক করে ফেললেন, স্কুল-বাড়িটাই পুড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু এলাকার ধর্মান্ধ রক্ষণশীল মানুষের তরপাণিতে ছাত্ররা ভয় পেল না। অন্যদিকে ধর্মান্ধ রক্ষণশীল মানুষের দলটিকেও ঠেকিয়ে রাখা গেল না।

অনেক ছাত্রকেই সেদিন গৃহত্যাগী হতে হয়েছিল। অক্ষয়-জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন: উপস্থিত বৃত্তান্তটি সঞ্জীবনী-পত্রিকার সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়। তিনি ঐ সময়ে ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন।জানা যায় দ্বারকানাথ ঠাকুরের ওপরও এই ঘটনারদারুণ প্রভাব পড়েছিল। তাঁরা কুলীন ছিলেন, পরিবারে প্রায় সবাই বংশানুক্রমে চল্লিশ-পঞ্চাশটি করে বিয়ে করতেন। দ্বারকানাথ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘আমি এক বই দুই বিবাহ করিব না’।

‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ পাঠে দেবেন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি কোথায়, আর তিনি কোথায়। আমি খুঁজিতেছি ঈশ্বরের সঙ্গে আমার কী সম্বন্ধ; আর তিনি খুঁজিতেছেন, বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির কী সম্বন্ধ; আকাশ পাতাল তফাৎ।’ তফাৎটা শেষ পর্যন্ত দুঃসহ হয়ে পড়েছিল; দেবেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, ‘কতগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহাদিগকে এ পদ বইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।’

প্রসঙ্গত, অক্ষয়কুমার মানুষের জীবনে ধর্ম হুকুম করবে, এটা তিনি মন থেকে মেনে নিতে একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। কারণ চিন্তা ও চেতনায় তিনি ছিলেন সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকা মানুষ। তবে বেদ-বেদান্ত উপনিষদ নিয়ে তর্ক করার কোনও উৎসাহ পেতেন না।অন্যদিকেহিন্দু ধর্মবাদিতা তাঁর জীবনে প্রশ্রয় পায়নি। তিনি ‘ধর্মনীতি’ নামে বই লিখেছিলেন ঠিকইকিন্তু সে বইয়ের বিষয়বস্তু আধ্যাত্মিক নয়, জাগতিক ও সাংসারিক।

অক্ষয়কুমার দত্তএকটানা বারো বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। পত্রিকাটি যে সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পত্রিকার মালিক ছিল ব্রাহ্ম সমাজ, যার প্রধান ছিলেন রামমোহনের পথানুসারী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের পিতা।১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকা সম্পাদনার ভার দেন অক্ষয়কুমার দত্ত-র ওপর।ওই পত্রিকাতেই একের পর এক অসামান্য বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা বেরোতে থাকে। কিন্তু ওই ঘটনার পর 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকা সম্পাদনার কাজে অক্ষয় কুমার অযোগ্য বিবেচিত হন। তাঁর চাকরি যায়।
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version