প্রথম পর্ব

রাঢ় বাংলার পূর্ব বর্ধমান জেলার অর্ন্তগত কালনা মহকুমার বৈদ্যপুর এক প্রাচীন গ্রাম। এলাকায় আছে জমিদার বাড়ি। এছাড়া গ্রামটিকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য হিন্দু দেবদেবীর মন্দির। মনসামঙ্গল কাব্যে এই গ্রামের নাম পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্য উল্লেখ্যোগ্য। গ্রামটি রথতলা,  রাসতলা,  ঘোলার পাড়,  নন্দীপাড়া, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া সহ বেশ কয়েকটি এলাকা নিয়ে গঠিত। চাঁদ সওদাগরের পুত্রবধূ বেহুলা যখন তার মৃত স্বামী লখিন্দরকে নৌকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন; তখন এই গ্রামের চিকিৎসকেরা লখিন্দরকে সুস্থ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। চিকিৎসকদের স্থানীয় ভাষায় ‘বৈদ্য’ বলা হতো, তাই গ্রামের নাম হয় বৈদ্যপুর। মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে কিংকরমাধব সেন বৈদ্যপুরের জমিদার ছিলেন। পরবর্তী সময়ে সম্পন্ন ব্যবসায়ী নন্দীদের জন্য বৈদ্যপুর একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।

বৈদ্যপুরের অন্যতম আকর্ষণ জোড়া-দেউল- ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ, ভারত সরকারের পুরাতত্ব বিভাগের অধিগৃহিত। ডেভিড জে ম্যাককাচিয়ন বলেন- ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয়েছে এই স্থাপত্য। জোড়া-দেউল নির্মাণের প্রায় ষাট/সত্তর বছর পরে ব্যবসা সূত্রে মেমারি থানার দেহুড়া থেকে নন্দীপরিবারের প্রথম পুরুষ হারাধন নন্দী বৈদ্যপুর গ্রামে এসেছিলেন ১৬৫৮ সাল নাগাদ। জাতিতে তিনি ছিলেন তিলি। পরবর্তীতে নন্দী বংশের উত্তর-পুরুষদের লবণ, সাজিমাটি, চুন ও ধানের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। মালদা ও বিভিন্ন জেলা থেকে জমিদারির(১৭৯৮)আয় থেকে আসে পারিবারিক সমৃদ্ধি। এরপর বর্ধমানরাজের কাছ থেকে পত্তনিদার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ(১৮১৯) করে। জমিদারির সমৃদ্ধি থেকেই বৈদ্যপুরে তাঁদের বসতবাড়ি ও মন্দির সহ অন্যান্য স্থাপত্যগুলি নির্মিত হয়। পরবর্তীতে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, পারিবারিক বিভাজন, আর্থিক অসঙ্গতি ইত্যাদি নানা কারণে সেগুলোর সংস্কার ও পরিচর্যা হয় না।

জোড়া দেউল (১৫৫০) সালে শুভানন্দ পালের জোড়া দেউল। ডেভিড জে ম্যাক্‌কাচিয়নের মতে জোড়া দেউল-এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু এএসআই-এর একটি ফলকে জোড়া দেউলের স্থাপনাকাল আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ বলা হয়েছে। প্রাচীনত্ব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত এক নয়। অনেকে এটিকে কৃষ্ণের মন্দির বলেছেন, আবার কেউ বৌদ্ধমন্দিরের পক্ষে সায় দিয়েছেন। কেউ পালযুগের দেউল বলেও মতামত প্রকাশ করেছেন। জোড়া দেউল ভারতীয় পুরাতত্ত্ব কর্তৃক সংরক্ষিত। বড় মন্দিরটি পূর্বমুখী ও ছোটটি উত্তরমুখী। মন্দিরের দেওয়াল সুক্ষ্ম টেরাকোটার কাজ। বর্তমানে কোনও বিগ্রহ নেই। জোড়া দেউলের বড়টি প্রায় ৩০ ফুট ও ছোটটি প্রায় ২০ ফুট উঁচু। বড় দেউলে প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকে একটি দরজা আছে। ছোট দেউল দিয়েও প্রবেশ করা যায়। মূল মন্দিরের ওপরে প্রতিষ্ঠালিপি আছে তবে অস্পষ্টতার কারণে পুরো লিপিটি পড়ে উদ্ধার করা যায়না। পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় গুরুত্বের স্মৃতিস্তম্ভের তালিকা অনুসারে বৈদ্যপুর গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন জোড়া দেউল। প্রাচীনত্বের দিক থেকে এটি সাত দেউলিয়ার পরে এবং ইছাই ঘোষের দেউলের আগে।

বৈদ্যপুরের প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান জোড়াদেউল(১৫৯৮) অন্য মতে (১৫৫০), জোড়া শিব মন্দির ও নন্দী পরিবারের শিব মন্দির(১৮০২), বৃন্দাবন চন্দ্রের সোজা কোণযুক্ত নবরত্ন মন্দির(১৮৪৫), রাজ রাজেশ্বর মন্দির, নারকেলডাঙ্গার জগৎগৌরী মন্দির, গোপালদাসপুরের রাখাল রাজার মন্দির। এ ছাড়াও বৈদ্যপুর গ্রামের অতীত সমৃদ্ধির পরিচায়ক হিসেবে আছে চালা, দালান, রত্নরীতির বেশ কিছু মন্দির, রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, ভদ্রাসন, কাছারিবাড়ি, বৈঠকখানা, নহবতখানা ইত্যাদি। এইসমস্ত মন্দির এবং অন্যান্য স্থাপত্যগুলির নির্মাতা গ্রামের জমিদার নন্দী পরিবার।

বুড়ো শিব মন্দির- সুন্দর টেরাকোটার কাজ। কিছু নতুন করে প্লাস্টার করা হয়েছে কিন্তু কিছু কাজ এখনও আছে। যা রামায়ন ও  কৃষ্ণলীলা। বৈদ্যপুর গ্রামের প্রাচীন দেবতা বাবা বুড়োশিব, বাবাবুড়োশিবের অনেক অলৌকিক কাহিনী গ্রামে ছড়িয়ে আছে। পুজোর ৯ মাসের দায়িত্ব গ্রামের পাল পরিবারের ও ৩ মাস নন্দী বংশের। শিবরাত্রি, নীল, গাজন বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়।

(হাওড়া বর্ধমান মেন লাইনের যে কোনো লোকাল ট্রেনে বৈঁচি নেমে, স্টেশন থেকে কালনাগামী যে কোনো বাসে অথবা, হাওড়া কাটোয়াগামী ট্রেনে কালনা নেমে, বৈঁচিগামী বাসে বৈদ্যপুর যাওয়া যায়।) 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version