চতুর্থ পর্ব

দু’পাশে শুধু দেখা যায় চিমনি, বেশির ভাগই ইটভাটার। জাহাজের দোলায় ঢেউয়ের মাথায় নেচে উঠেছে জেলে ডিঙি। জলের স্রোতে দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে, কচুরিপানা, পচা কলাগাছ, বাসি ফুল, মরা গরু, আরও কতকিছু। হঠাৎ আবার ঘটাং, দাঁড়িয়ে পড়েছে জাহাজ। কি ব্যাপার?  নদীতেও ট্রাফিক জ্যাম হয় নাকি? জানা গেল জাহাজ আটকে গেছে নদীর চরায়। দুপুরের জোয়ার না এলে আর নড়বে না। এও জানলাম এখন জাহাজ চালাচ্ছে পাইলট। নদীর ঘ্যাঁতঘোঁত তার জানা, এখানে ক্যাপ্টেনের জারিজুরি চলবে না। ক্যাপ্টেন দায়িত্ব নেবে সেই মোহনা তে গিয়ে। বিশাল দড়ির মই বেয়ে পাইলট নেমে গিয়ে উঠবে তার বোটে, চলে যাবে অন্য কোনো জাহাজের দায়িত্ব নিতে। এই পাইলটের নেমে যাওয়ার ব্যাপারটা নাকি ইংরেজি থ্রিলারের মতো দারুণ রোমাঞ্চকর। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এটা না দেখে ছাড়বো না। যদিও শেষ পর্যন্ত দেখা হয়ে ওঠেনি। তবে ফেরার সময় দেখেছি। সেকথা পরে।

নিজের জায়গায় এসে দেখি আমার উল্টো দিকের সাউথ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি সবাই কে নিয়ে নিজেদের সঙ্গে আনা খাবার দাবার বের করে ফেলেছে। দেখে আমাদের পান্তা ভাতের মতোই মনে হলো। পরিবারের কর্তা একগাল হেসে চোখের ইঙ্গিতে আমাকেও আহ্বান জানালেন। হাসি মুখে চোখের ইঙ্গিতে না জানিয়ে আমি ঢুকলাম স্নান ঘরে। জাহাজের ডাইনিং হলে খেতে হলে সকালেই পয়সা দিয়ে কুপন সংগ্রহ করতে হবে। মাছ, মাংস বা ডিম যা খাবেন সে সিদ্ধান্তও নিতে হবে আগেই। খাওয়ার আগে পয়সা দিলেই খাওয়ার মিলবে না, এমনকি বাড়তি ভাত নিতে চাইলেও  সে ব্যবস্থা করে রাখতে হবে সকাল সকাল।  আর রাতের জন্য  বিকেলের মধ্যে, বোধহয় রান্না শুরু হওয়ার আগে। একমাত্র চা ছাড়া কোন কিছুই আগে না জানিয়ে পাওয়া যাবে না। খাবার জন্য যা ভাত দেয় মোটমুটি আমার পেট ভরে যাওয়ার মতো। একস্ট্রা ভাতও সম পরিমানের। অর্থাৎ সব কিছুই মাপে মাপে।

খাওয়া দাওয়ার পর নিচে নেমে দেখি, আমার উল্টো দিকের দক্ষিনি লোকটি তারই মতো কয়েকজন কে জুটিয়ে তাস খেলায় মন দিয়েছে। ভাষা না বুঝলেও হাবেভাবে বুঝলাম জুয়ার আসর বসেছে। ওদের ভাবভঙ্গী বেশ বেপরোয়া, মদ খাওয়াও চলছে। সেটাও সম্ভবত বাড়ি থেকে নিয়ে আসা চোলাই। ওদের হেলদোল নেই, আমিই পড়লাম অস্বস্তি তে। কোথায় চোখ রাখবো বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এখানে আমিই অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশকারী। প্রায় বেলা গড়িয়ে জোয়ার আসার পর জাহাজ ছাড়লো, তারপর মাঝ রাতে মোহনায় পাইলট কে নামিয়ে একটানা সেই ‘ডিকলিপুর’। সেখানে প্রায় সমুদ্রের বুকে কিছু যাত্রী নামিয়ে এক্কেবারে পোর্ট ব্লেয়ার।

আলাপ হওয়ার পর থেকে আমি এঁটুলির মত লেগে রয়েছি কল্যাণীর ওই বি এড গ্রুপ বিশেষত কমল দার সঙ্গে। অন্যরা হয়তো ধরে নিয়েছেন আমিও ওদের মতোই কল্যাণীর ছাত্র। ওদের সঙ্গেই ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম জাহাজের ইতিউতি। আমাদের সস্তার ডেক বা ব্যাঙ্ক ক্লাসের পুরোটাই নাকি রয়েছে  জলের  প্রায় ১৬ ফুট নিচে। ডেকের উপর সারি সারি বিভিন্ন কেবিন। উপরের কেবিন গুলো সৌখিন এবং বাহারী হলেও নিচের ব্যাঙ্কে নাকি আরাম বেশি। জলের নিচে থাকায় জাহাজের দুলুনি এখানে কম। শান্ত সমুদ্রে জাহাজের দুলুনিতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বিশেষত কেবিনের যাত্রীরা। আর সমুদ্র অশান্ত হলে, সে নাকি এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।

জাহাজ এখন সমুদ্রে, একটানা জলকেটে এগিয়ে চলছে আন্দামানের দিকে। চারিদিকে জল ছাড়া দৃশ্যমান কোন কিছুই নেই। পেছনে ঘুরন্ত প্রপেলার সাদা ফেনা ছড়িয়ে জলের এক ঘুর্ণিপথ তৈরি করেছে। কিছু মাছ জল থেকে লাফিয়ে উঠে আবার আশ্রয় নিচ্ছে জলে। সবার অবশ্য পুনরায় জলে ফিরে আসার সৌভাগ্য হচ্ছে না, মাছের আশায় সেখানে ওড়াউড়ি করছে বেশ কিছু গাঁঙচিল। মুহূর্তে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে মাছ। আপাতত পোর্ট ব্লেয়ার পর্যন্ত এটাই নাকি আমাদের একমাত্র দেখার জিনিস। জলের রঙ এক্কেবারে কুচকুচে কালো, সমুদ্রের গভীরতার কারণে নাকি জলের রঙ এমন কালো মনে হয়। সে কারণে একে অনেকে বলে ‘কালা পানি’। 

চলবে

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version