তৃতীয়পর্ব

এইপর্বের শুরুতে কয়েকটি কথা না বললেই নয়, এটা একরকম আমার কৈফিয়তও বটে। এ লেখা পড়ে যাঁরা কিছু ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন প্রথমে তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। এদের অন্যতম আমার সহপাঠী বন্ধু মলয়। আন্দামান যাওয়ার জন্য যেদিন আমি জাহাজে উঠি, সেদিন মলয় খিদিরপুরের ৩ নম্বর ডকে উপস্থিত ছিল। মলয়ের সঙ্গে আরও যে বন্ধু ছিল সে অশোক নয়, সে ছিল আমার আবাল্য বন্ধু তাপস।আরও একজন, তিনি আলি দা। ওঁর মন্তব্যে মনে পড়লো সেই সময় ক্যাপস্টেনআর কাঁচিসিগারেট এক ছিল না। দুটিই আলাদা আলাদা। দুটিই সে সময়কার খুব চালু সিগারেট। একইসঙ্গে তাঁদেরও ধন্যবাদ জানাই যাঁরা পোস্ট করা মাত্রই না পড়েই লাইক দিয়েছেন। ভেবে দেখেননি অত বড় লেখা মিনিট খানেকের মধ্যে পড়া সম্ভব নয়।

এবার আসি কাহিনিতে। ভেবেছিলাম জাহাজ ছাড়বে এবং কলকাতা ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে যাবে সাগরের দিকে। কিন্তু কোথায় কি? জাহাজ তো অনড়। চারিদিকে শুধু হইহল্লা আর দড়ি টানাটানি। অনেক রাত পর্যন্ত জাহাজ ছাড়বে এই আশায় ডেকেই দাঁড়িয়ে রইলাম। জাহাজ কিন্তু স্থির। পরিবর্তন বলতে জাহাজে ওঠার লম্বা সিড়িটা শুধু সরে গেছে। একসময় হতাশ হয়ে নেমে এলাম নিজের জায়গায়। খুব ক্লান্ত লাগছে, ভেতরের শঙ্কা হয়তো আমাকে বেশ কাহিল করে দিয়েছে। না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। চারিদিকে ফিসফাস, মাঝ মাঝেই উচ্চস্বরে হাসাহাসি, খকখক খুকখুক কাশি আর বিচিত্র নাক ডাকার শব্দ। কোথাও থেকে ভেসে আসছে একটা সেতারের সুর। চোখ খুলে রাখলেও যমুনা বালা আবার চোখ বোজালেও যমুনা বালা। কখন যেন একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙতেই এক ছুটে উপরের ডেকে, ভেবেছিলাম জাহাজ বোধহয় সমুদ্রে। হায় কপাল,  জাহাজ তো এখনো স্থির। সারা রাতে এগিয়েছে বড়জোর হাজার, দেড় হাজার মিটার। ডক থেকে বেরিয়ে জাহাজ এখন মাঝ গঙ্গায় দাঁড়িয়ে। ডেকের উপর খোলা জায়গায় কাঁথা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে বেশ কয়েকজন। জাহাজের কর্মী যে নয়, দেখেই বোঝা যায়। তবে এরা কারা? সে উত্তর পেয়েছিলাম ফেরার সময়। তখনও ঠিক ঠিক সকাল হয়নি। ধীরে ধীরে পুব আকাশে রঙ ধরলো। খিদিরপুরের কাছে এ গঙ্গায় সূর্যদয়ের কোনও শোভা নেই। চারিদিকে কারখানার কালিঝুলি মেখে মুমূর্ষু রুগীর মতো এ গঙ্গা ধুঁকছে। ঘোলা জলে কচুরিপানা, পচা ফুল এমনকি পচে ফুলে ঢোল হওয়া কুত্তাও ভেসে গেল। ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার ভারি আকাশ রয়েছে ঝুলে। তাদের ঠেলে আকাশে জায়গা নিতে হাঁসফাঁস করছে সূর্য,  একসময় জাহাজের ডেকে বিবর্ণ আলো ছড়িয়ে দিন শুরু হলো। কারখানার ভোঁ বাজছে, গঙ্গার বুকে ছোটখাটো স্টিমার বা লঞ্চেও ভোঁ। আমাদের বিশাল জাহাজ কিন্তু তখনও স্থির। তার ঘুম এখনো ভাঙেনি।

নেমে এলাম নিজের জায়গায়। নীচের ওই ধুতি পাঞ্জাবি পরা সৌম্য ভদ্রলোক নাকি প্রায়ই আন্দামান যাতায়াত করেন। কোনও এক ব্যবসার কারণে। খুব একটা খুলে বলতে চাইছিলেন না। বাড়তি কৌতুহল আমিও দেখাইনি। আন্দামানে ওই ভদ্রলোক ও আমি পাশাপাশি ছিলাম,তখন  আমাকে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। সে গল্প যথা সময়ে। সকালের কাজকর্ম সেরে, কমলদা ও তার বন্ধুদের সঙ্গে উঠে এলাম জাহাজের ডাইনিং হলে। বেশ প্রসস্থ হল, একসঙ্গে শ’খানেক লোকের পাত পড়বে। টেবিল চেয়ার সব মেঝের সঙ্গে নাট বোল্ট দিয়ে শক্ত করে আঁটা। এখন সমুদ্র হয়তো শান্ত থাকবে কিন্তু অশান্ত হলে থালা’বাটি সহ চেয়ার টেবিলও নাকি ছিটকে চলে যায়। চা,জলখাবার থেকে আরম্ভ করে দুপুর ও রাতের খাবারও পাওয়া যায়। তবে দাম বেশ চড়া। অবশ্য এখন চড়া বললে বেশ হাস্যকর শোনাবে। যতদূর মনে পড়ে সবজি ভাত বা রুটি ৬ টাকা, জল খাবার ৩ টাকা আর চা ১ টাকা। মাছ, মাংস কিংবা ডিম আলাদা।

চা’জলখাবার খেয়ে সবার সঙ্গে উঠে এলাম উপরের ডেকে। লজ্জা লজ্জা মুখ করে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, এমন সময় ভোঁ। নড়ে উঠলো জাহাজ। আমরা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলাম, ছুটে গিয়ে বুক চেপে দাঁড়ালাম জাহাজের রেলিংয়ে।ধীরে ধীরে আমাদের জাহাজ জল কেটে কলকাতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছে সমুদ্রের দিকে। একে একে বাঁদিকের কারখানা ডানদিকে আমার কলেজের পাশে বোটানিক্যাল গার্ডেন সব চলে গেল চোখের বাইরে। এখন আর কোনও চেনা নেই।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version