তখনও তিনি কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেননি।তবে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘টুইলাইট’-এর কারণেএকটু নামটাম হয়েছে। কবি সেই সময় বন্ধুদের সঙ্গে একটি সস্তা সরাইখানায় যেতেন। সেখানে মদের দামটাও তুলনামূলক কম ছিল তাছাড়া এক দল মেয়ে সেখানে সন্ধেবেলা নাচ গান করতো। ফলে সন্ধে হলেই সাধারণ লোকেরা যেমন সেখানে ভিড়জমাতো কবিও তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন ওই সরাইখানায় হাজির হতেন এবং মদের সঙ্গে আড্ডা জমাতেন। বলাই বাহুল্য মদের দাম যেখানে কম এবং সঙ্গে মেয়েদের নাচগান, সেখানে যে নানা ধরণের লোকের সমাগম হবে বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষই যে সেখানে ভিড় করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে নানা ধরণের লোকের ভিড়ে দালাল, ছিঁচকে চোর, গুণ্ডা জাতীয় লোকেরাও আসর জমাতো। মাঝে মধ্যেই তাদের নিজেদের মধ্যে লেগে যেত মারপিট।

রোজকার মতো সেদিনও কবি তাঁর কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বসে সেই সরাইখানায় হাজির হয়েছেন। নাচ-গান শুরু হয়েছে। কবি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মদ্য পান করছেন এবং জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। অন্যদিকে ঠিক সেই সময় দুজন গুণ্ডা প্রকৃতির লোকের মধ্যে জোর বচসা শুরু হয়। একজন বেশ গায়ে পড়েই অন্যজনকে আক্রমণ করে এবং হাতাহাতি শুরু করে দেয় এবং অশ্রাব্য গালিগালাজও করতে থাকে। প্রায় রোজই এমন ঘটনা ঘটে কিন্তু সেদিন ঘটনাটি একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। চিৎকার চ্যাঁচামেচিটা এমন জায়গায় পৌছে গিয়েছিল যে সব টেবিলের আড্ডাতেই ব্যাঘাত ঘটে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সরাইখানার পরিবেশ পুরোপুরি বদলে যায়। যারা সন্ধ্যার পরে এসেছিল তারা খুব বিরক্ত হয়। কিছুক্ষণ পরে কেউ কেউ ভয়ও পেতে থাকলো। কারণ দুজন গুণ্ডার হাতেই ধারালো অস্ত্র, একে অপরকে আক্রমণ করতে উদ্যত। এদিকে কেউই এমনকি সরাইখানা কর্তৃপক্ষেরও গুণ্ডা দুজনকে কিছু বলার সাহস হল না। একমাত্র কবি উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর বন্ধুদের নিষেধ স্বত্বেও তিনি গুন্ডা দুটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং বললেন, এই হারামজাদারা, এখানে কেন ঝামেলা করছিস? আমরা  এখানে এসেছি মদ খেতে, গান শুনতে, তোদের মারামারি দেখতে নয়।

কবির শাসানিতে গুণ্ডা দুজন রীতিমতো চমকে গেল, তারা কবির মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ হ্যাঁ করে তাকিয়ে রইলো। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে একজন শান্ত ভদ্রলোক তাদের ভয় না পেয়ে বরং তাদের দিকে তেঁরে এসেছে। ওদের মধ্যে একজন ছিল বেটে খাটো, সে পায়ে পায়ে কবির সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু কবি এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে কিছু না ভেবেই গুন্ডাটির মুখে এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যায়। প্রতিপক্ষ তখন তাকে বাগে পেয়ে বেশ কয়েকটা ঘুষি চালায়। এরপর সেই গুণ্ডাটি কবির সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে, কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়। কিন্তু কবি তাকেও অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় কর্কশ ভাষায় তিরস্কার করেন, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে-ও সরাইখানা ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

এরপর সবাই ভয় পায়, বিশেষ করে কবির বন্ধুরা, সরাইখানা থেকে বাইরে বেরলেই গুণ্ডা দুজন কবির ওপর চড়াও হবে। কিন্তু একেবারেই উল্টো ঘটনা ঘটলো যা সত্যি বিস্ময়কর। ইতিমধ্যে সবাই কবিকে সাবাস জানালো।নানা ভাবে কবির সাহস এবং প্রতিবাদের প্রশংসা করলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন সবাই ভয়ে ভয়ে সরাইখানার বাইরে এল তখনই সেই আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটলো। সবাই দেখলো সরাইখানার অনতিদূরে একটি অন্ধকার গলির সামনে দ্বিতীয় গুন্ডা লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তাকে আরো ভয়ংকর দেখাচ্ছিল।

সবার মতো কবি ও তাঁর বন্ধুরা ভাবলেন, এবার আর কোনও বাঁচার রাস্তা নেই। লোকটি সরাইখানায় কোনও ঝামেলা করেনি ঠিকই কিন্তু বাইরে তৈরি হয়ে বসে আছে। এবার আর তার হাত নিস্তার নেই। কবিকে দেখামাত্র গুন্ডা লোকটি এগিয়ে কবির সামনে এগিয়ে এল। গুণ্ডাটি কবির হাত ধরে যেদিকে আলো সেদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানামানি শুরু করলো। তারপর বলল, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। আপনাকে আমি অনেকদিন ধরেই খুঁজছি। কবি ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। তাঁর বন্ধুরাও ভয়ে পিছনে পিছনে হাঁটছিলেন। কবি ভাবলেন ভয় পেলেও তা প্রকাশ করা যাবে না।

এরপরই গুন্ডা লোকটি কবিকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখে। কবির ভয় এতে একটু হলে কমতে থাকে। কবি লক্ষ্য করলেন গুন্ডা লোকটির মুখে কোনও রাগ বা প্রতিশোধ স্পৃহা নেই। সে অত্যন্ত বনয়ের সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি পাবলো নেরুদা? নেরুদা বললেন, হ্যাঁ। লোকটি তখন মুখ কাচুমাচু করে বললো, আমার মতো অধমকে আপনি ক্ষমা করবেন,আমি না জেনে বুঝে আপনাকে অপমান করেছি। আমি যাকে ভালোবাসি সে আপনার কবিতার খুব ভক্ত। আমরা দুজনে আপনার কবিতা পড়েই ভালোবাসতে শিখেছি। আপনার কবিতার জন্যই আমি তার ভালোবাসা পেয়েছি। এবার সে প্যান্টের পকেট থেকে একটি ফোটো বের করে কবির সামনে তুলে ধরলো এবং বললো, আপনি এই ছবিটি একবার স্পর্শ করুন তাহলে আমি তাকে বলতে পারবো পাবলো নেরুদার স্পর্শ পেয়েছো তুমি।  নেরুদা যেইমাত্র ছবিটি যখন স্পর্শ করলেন লোকটি উদাত্ত স্বরে নেরুদার কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলো। নেরুদা ও তাঁর বন্ধুরা যখন রাস্তা হাঁটছেন তখনও তাঁদের কানে আসছে তার আবৃত্তি।
Share.

2 Comments

  1. soma bhattacharya on

    নেরুদার মৃত্যুর পরে ফ্যাসিস্ট সেনাবাহিনী তাঁর ঘরবাড়ি লুটপাট করে অমূল্য সব সম্পদ, সংগৃহীত পুরনো বই, নথিপত্র, পাণ্ডুলিপি, পাবলো পিকাসোর দেওয়া ছবি ইত্যাদি সব কিছু নষ্ট করে ফেলে। এরপর বাড়ির সব কল খুলে সমস্ত কিছু জলে ভাসিয়ে দেয় যাতে সব কিছু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সেনাবাহিনীর সেই চেষ্টা সার্থক হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে নেরুদাকে মোছা সম্ভব নয়।

  2. sushovon talukdar on

    নানা ঘটনায় ঘটনাবহুল তার জীবন। ১৯৪৮ সালে চিলির ব্যবস্থাপক সভায় তিনি নির্বাচিত হন। আবার সে বছরই তাকে বহিষ্কার করা হয় এবং জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কবি পালিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ঘুরে বেড়ান ইউরোপ, সোভিয়েত ও চীন।

Leave A Reply

Exit mobile version