বিশ্ব জুড়ে দিনে দিনে উন্নত হচ্ছে পরিবহণ ব্যবস্থা। চিনের সাংহাই মাগলেভ থেকে শুরু করে জাপানের বুলেট ট্রেন— নজর কেড়েছে বিভিন্ন দেশের উচ্চগতির ট্রেন। ভারতেও শুরু হয়েছে হাইপারলুপের কাজ। তবে এখনও কয়েকটি দেশে এমন সব জায়গা রয়েছে, যেখানে পরিবহণের জন্য ঘোড়া, গাধা, উট ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর বুকে এমন এক দেশ রয়েছে, যেখানে ঘোড়ায় টানা ট্রেনে চেপে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেন সাধারণ মানুষ। সেই দেশ হল পাকিস্তান। ভারতের প্রতিবেশী দেশে এমন একটি জায়গা রয়েছে যেখানে সাধারণ মানুষ যাতায়াতের জন্য ঘোড়ায় টানা ট্রেনের উপর নির্ভর করতেন কয়েক বছর আগে পর্যন্ত।

আধুনিক বিশ্বে ভ্রমণের জন্য রেলগাড়ির বিকল্প নেই। বিশ্বে দ্রুতগতির বুলেট ট্রেনসহ মেট্রোরেল এবং ইন্টারসিটি ট্রেন রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ট্রেন চলে বিদ্যুতে, আর কিছু চলে ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে। পাকিস্তানে এমন এক ট্রেন চলে যা একেবারেই ব্যতিক্রম। এই রেলগাড়ি টানে ঘোড়া। রেললাইনের ওপর দিয়ে ঘোড়া গাড়িটি টেনে নিয়ে গেলেও গাড়িতে কোনো কামড়া নেই। নেই রেলের ছন্দময় কু ঝিক্‌ঝিক্‌ শব্দ। স্থানীয়দের ভাষায় এটি ‘ঘোড়ার ট্রেন’। 

পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ জেলার জড়ানওয়ালা এলাকার গঙ্গাপুরে এই ঘোড়ার ট্রেন চলে। রেল লাইনের উপর কাঠের তৈরি টেবিলের আসন পাতা থাকে। সেখানে ১৬-১৮ জন যাত্রী বসতে পারেন। আসনের নিচে চাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের পরিত্যক্ত চাকা। রাস্তার দুই প্রান্তে দুটি গ্রাম। দুই গ্রামেই যাত্রী ওঠা-নামার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট স্থান। মূলত দুইদিক থেকে আসা ঘোড়ার ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করা হয়। এখানে নেই কোনো ক্রসিং সিস্টেম। মাঝপথে একটি আরেকটির সঙ্গে দেখা হলে যাত্রীরা গাড়ি বদল করেন।

এই গাড়ি চালু করেন স্যার গঙ্গারাম আগরওয়াল। পাঞ্জাবে জন্ম হলেও গঙ্গারাম চাকরিসূত্রে কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর কাজ করতেন ব্রিটিশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগে। লাহোরে নানান স্থাপত্য, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ নির্মাণের কারিগর তিনি। ১৯০৩ সালে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের ভারত যাত্রার সময় গঙ্গারাম দিল্লির রাজদরবার দেখা-শোনার দায়িত্ব পান। নানান নান্দনিক কাজের জন্য তার নামের পাশে রায়বাহাদুর খেতাব যোগ করা হয়।

গঙ্গারামকে আরও ৫০০ একর জমি অনুদান দেওয়া হলে তিনি নিজের নামে গড়ে তোলেন নতুন গ্রাম। চাষবাসের উন্নত জিনিসপত্র না এলে কীভাবে বেশি ফসল হবে, এই চিন্তা থেকে গঙ্গারাম গঙ্গাপুর থেকে বুচিয়ানা পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রাস্তায় নিজেই বিছিয়ে দিলেন রেলপথ। সবাই যখন বললো রেল আর ইঞ্জিন পাবেন কোথায়? তখনই তিনি বের করলেন সমাধান। বললেন, এই ট্রেন চালাবে ঘোড়া।

শোনা যায়, গঙ্গারাম এই গাড়ি চালু করেন তার মেয়ের জামাইয়ের পরামর্শে। জামাইকে এই রেলগাড়ি তিনি উপহার দিয়েছিলেন কারণ বুচিয়ানা থেকে তার গ্রামে আসতে জামাইকে যেন কষ্ট পোহাতে না হয়। ১৯০৩ সাল থেকে ঘোড়ার ট্রেন চালু হয়। জানা যায়, নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৯৮ সালে। শুরুতে এই ঘোড়ায় টানা ট্রেনে ১৫ জন মানুষ চড়তে পারতো। ভালোই চলছিল ব্যবসা কিন্তু ১৯৯৩ সালে এটি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দুর্বৃত্তরা রেল লাইনের ইস্পাত চুরি করে নিয়ে যেত। ২০০৬ সালে স্থানীয় কাউন্সিলর মুনাওয়ার খান এটি আবার চালু করার উদ্যোগ নেন। ফয়সালাবাদ জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ২০০৭ সালে আবার চালু হয় ঘোড়ায় চালিত ট্রেন। কিন্তু ২০২১ সালের পর এই ট্রেন জৌলুস হারিয়ে ফেলে। এক সময় অনেক পর্যটক এই গাড়ি দেখতে এলেও এখন আর কেউ তেমন আসে না। ফলে আগের মতো প্রতিদিন এই গাড়ি চলে না।

এই ঘোড়ায় টানা ট্রেনের জন্য রয়েছে স্টেশন, যাত্রী ছাউনি ও টিকিট কাউন্টার। যাত্রীরা স্টেশন থেকে টিকিট কাটেন। যাত্রী ছাউনির নিচে অপেক্ষা করেন। ঘোড়ায় টানা ট্রেন এলে চড়ে বসেন। গঙ্গাপুর থেকে বুচিয়ানা রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৩ কিলোমটিার পথের মাঝখানে আছে যাত্রাবিরতি। অর্থাৎ দুই দিক থেকে দুটি ঘোড়ায় টানা ট্রেন চলে। মাঝপথে যাত্রীরা ট্রেন পরিবর্তন করেন। ওপাশের ট্রেনের যাত্রীরা এপাশের ট্রেনে ওঠেন। আর এপাশের ট্রেনের যাত্রীরা ওপাশের ট্রেনে। এই ফাঁকে চালকরা তাদের ঘোড়ার দিক পরিবর্তন করেন। এই ট্রেন ঘোড়া যখন পূর্ণ গতিতে টানে তখন তার গতি হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার।

কেবল স্থানীয়রাই নয়, বিভিন্ন দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে এই ঘোড়ায় টানা ট্রেনে চড়ার জন্য। দেখার জন্য। বর্তমানে এই ট্রেনে ২০ থেকে ২৫ জন চড়তে পারে। অবশ্য পাকিস্তানের মতো কম্বোডিয়ার বাটামবাং প্রদেশে আছে বাঁশের তৈরি অদ্ভুদ ট্রেন। সেটা অবশ্য ছোট ইঞ্জিন দিয়ে চালানো হয়।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version