নারকোল তেল জমে শ্বেতপাথর। শীত এলো বর্ষার হাত ধরে। নিছক অতিথি বৈ তো নয়, বড়জোর মাস দুই ‘তিন তার মেয়াদ, তাই তাকে বরণ করে আনতে হয়। সেই কাজ করে প্রাক্ শীতের নিম্নচাপ, মেঘলা দিন আর দফায় দফায় বৃষ্টি।

‘বালিশ-তুলো’, ‘লেপ করাবে গো’- হাঁকডাক অবশ্য শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই, সাইকেলে বাঁধা তুলোর প্যাঁটরা, কাঁধে তুলোধোনা একতারা। রাস্তার ধারে দরমার ঘেরাটোপে হরেক রঙ্গিবিরঙ্গি পশমি পসরা, মিঠে রোদে বৌঠাকুরানীর হাট।

এখন আর হাতে বোনা সোয়েটার দেখি না বিশেষ। উলবোনা শেখার পর আমার বাড়ির কেউ আর একটা সময় পর্যন্ত কেনা সোয়েটার পরেনি। সে এক নাছোড় নেশা- একটা’র পর একটা বুনে যাওয়া। খাতা বোঝাই গ্রাফের ডিজাইন, প্যাটার্ন লেখা। উলকাঁটার যুগলবন্দীতে মিশে থাকত ভালোবাসার আতর, তৈরি হত নতুন নতুন সৃজন, অনেক পরিশ্রম, নিবিষ্ট একাগ্রতায়। সেগুলো যখন আপনজনদের গায়ে উঠত, এক অনন্য সন্তুষ্টির অনুভব যেন সব কষ্ট ভুলিয়ে দিত। যাক্ সে কথা।

475454964

বাড়িতে ধুনুরি ডাকা হয়েছে, লেপ করানো হবে। বড় উঠোন চত্বরে তারা দুজন সাজ সরঞ্জাম নিয়ে গুছিয়ে বসল। গৃহকর্ত্রী পোড় খাওয়া সংসারী, বললেন, তুলোয় মিশেল না দেয় নজর রেখো, ওজনটা দেখে নিও। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বাড়ির আত্মপ্রত্যয়ী কর্তা তাঁকে অভয় দিলেন- কোনো চিন্তা নেই, আমি তো আছি। গিন্নির দাঁড়াবার জো নেই, হেঁশেলের যাবতীয় কাজ বাকি, তিনি উঠোন ছেড়ে সোজা রান্নাঘরে।

মিনিট পনের-কুড়ি পর কফির গ্লাস হাতে গৃহিণীর পুনঃপ্রবেশ। ইতিমধ্যে তুলো ধোনা শুরু হয়ে গেছে। সারমেয় দুটি উড়ুক্কু তুলোয় উমনো-ঝুমনো ভূত প্রেত হয়ে বসে আছে, বেচারা! কর্তা লেপ গঠন প্রকল্পের উল্টো দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে পিঠে রোদ নিয়ে একমনে কাগজ পড়ে যাচ্ছেন। গিন্নির উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন, কফি এনেছ, দাও।

দুই নবাগতর হাতে কফির কাপ তুলে দিয়ে গিন্নি নিচুগলায় কর্তাকে বললেন, তোমাকে বললাম… একটু দেখে নিলে না! কর্তার নিরুদ্বিগ্ন স্বর- না, না, ওরা ঠকাবে না, আমায় বলেছে “আল্লাহ্ কসম্”।

লাল শালুতে দু’দুটো লেপ তৈরি হল, সুন্দর পদ্ম সেলাই দিয়ে। কিন্তু হা কপাল! কিছুদিন যেতে না যেতেই লেপ না তোশক বোঝা দায়! বেজায় ভারী। রাশি রাশি তুলোবীজ ওয়ার আর শালুর আড়ালে বিশাল ময়দানে যেন অবাধে হাডুডু খেলে বেড়াতে লাগল।

বাবার মুখ ভার সহ্য করা যায়! ছেলেমেয়ে বাপকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, বোঝাতে চায় তাদের বাবা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা, অন্যরকম। ছেলেমেয়ের মায়ের চোখে জল, স্বামীর হাতটা ধরে একগাল হেসে বললেন, একটা সামান্য ব্যাপারে এত মনমরা হয়ে আছ? আমি তো আছি, চিন্তা কোরো না… এরপর থেকে এসব ঝামেলার কাজ আমিই দাঁড়িয়ে থেকে করাবো।

এবার হাসি ফুটল সেই মানুষটার মুখে, যিনি নির্বিশেষে বিশ্বাস করতেন সবাইকে, সব মানুষকে, আজীবন। ধুনুরির তুলোধুনো যন্ত্র আজও একইভাবে ছন্দে ছন্দে সুর তোলে, আমি  শুনি ‘আল্লা/ কসম্’ ‘আল্লা / কসম্’।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version