এ দেশের রাজনীতিতে নেতাদের দল বদল কি কোনও বেনজির বা বিস্ময়কর ঘটনা? লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল সুভাষ কাশ্যপের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১- এই পাঁচ বছরে আমাদের দেশে ১৯৬৯টি দলবদলের ঘটনা ঘটেছিল৷১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে বাংলা কংগ্রেসের নেতা তথা যুক্তফ্রন্ট সরকারের খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে ১৭ জন বিধায়ক সরকার থেকে বেরিয়ে এসে পিডিএফ গঠন করেন৷ ১৯৬৭-র নভেম্বর মাসে রাজ্যপাল ধরমবীর বিধানসভার অধিবেশন না ডেকে, আস্থা ভোটের সুযোগ না দিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার খারিজ করে দিয়ে প্রফুল্ল ঘোষকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানান।কংগ্রেসের সমর্থনে তৈরি হয় পিডিএফ সরকার, মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্ল ঘোষ। তবে সেই সরকারও তিন মাস পর ভেঙে যায়। রাজ্যে শুরু হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। পরবর্তীতে পিডিএফ ভেঙে আবার তৈরি হয়েছিল আইএনডিএফ৷ উল্লেখ্য, দলত্যাগ করে নতুন দল গঠন করার লক্ষেও ছিল ক্ষমতার অংশীদার হওয়া৷ যেমন ১৯৯৭ সালে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে আস্থাভোটে জেতার জন্য কংগ্রেস থেকে ২২ ও বহুজন সমাজ পার্টির থেকে ১২ জন বিধায়ককে ভাঙিয়ে এনে নিজেদের দলে এনেছিল৷ ২০১৭ সালে গোয়ায় কংগ্রেস বৃহত্তম দল হয়েও ক্ষমতা দখল করতে পারেনি, বিজেপি বিধায়কদের ভাঙিয়ে সরকার গড়ে৷

তবে দল বদলের ঘটনা যে একটি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিতে পারে সেটা প্রথম দেখা যায় ২০১১ সালে। তখন এ রাজ্যে একটানা ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটলে ক্ষমতায় পালা বদল হয়। নির্বাচনে বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যের শাসনভার লাভ করে। রাতারাতি হাজার হাজার বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী সিপিএম ও অন্যান্য বাম দল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে ভিড় জমায়। ওয়ার্ড কমিটি থেকে জেলা কমিটি; কোথায়ও পঞ্চায়েত সমিতি তো কোথাও জেলা পরিষদ বা কোথাও গ্রাম পঞ্চায়েত বা জেলার শীর্ষ নেতা, বিধায়ক প্রাক্তন বিধায়করাও তখন দল বদলেছিলেন। আর সেইসব নেতা-কর্মীদের তৃণমূল কংগ্রেসে স্বাগত জানিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কয়েক মাস পরই সেই জোট ভেঙে যাওয়ায় সরকার থেকে কংগ্রেস বেরিয়ে যায়৷ ১৭ জন কংগ্রেস ও ৬ বাম বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেন৷  পরবর্তীতে দলবদল আমফানের আকার নেওয়ায় তৃণমূল শাসনের প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই স্থানীয় প্রশাসন অর্থাৎ পঞ্চায়েত ও পুরসভা শাসকদলের হাতে আসে৷ বিরোধীদের অভিযোগ, ভয় দেখিয়ে ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বাম এবং কংগ্রেস জনপ্রতিনিধিদের নিজেদের শিবিরে টেনে আনে তৃণমূল৷ যদিও শাসকের দাবি, স্বেচ্ছায় জনপ্রতিনিধিরা ঘাসফুল শিবিরে যোগ দিয়েছেন৷

ফের দলবদলের ঝড় ওঠে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে। তৃণমূলইযে ফের ক্ষমতায় ফিরবে, সেটা নিশ্চিত জেনেই রাজ্জাক মোল্লা, উদয়ন গুহর মতো বামফ্রন্টের বেশ কয়েকজন ভারী নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী তৃণমূলে নাম লেখান। তাঁদের পথ ধরে দিদির দলে ভিড়ে যান আরও কয়েক হাজার অনুগামী। উল্লেখ্য, তৃণমূল জমানার শুরু থেকেই পুরনো তৃণমূলরা অন্যদল থেকে আসা নেতা কর্মীদের চাপেক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। নব্য তৃণমূলদের আধিপত্যে কোনও কোনও পুরনো তৃণমূল নেতা দলে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েন। ক্ষুব্ধ নেতারা তাঁদের সেইক্ষোভ অনেক সময় প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়েও উগড়ে ফেলেছিলেন। তবে ২০১৬-তেই দলবদল কিছুটা চরিত্র বদলায়। বিজেপিসে বছর বিধানসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে তাদের ভোট বাড়াতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে বাম ও কংগ্রেস নিজেদের আরও দুর্বল সাব্যস্ত করলে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী রাজনীতি করা লোকজন তৃণমূল থেকে বেশি সুবিধার লোভে বিজেপির দিকে ঝুঁকে পরেন। বিজেপির পালে হাওয়া লাগছে আঁচ পাওয়া মাত্র লোকসভা নির্বাচনের আগেই ঘাস ফুল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানো শুরু হয়। কার্যত তৃণমূল, কংগ্রেস এবং সিপিএম- এই তিন দলের মধ্যে তুলনায় তৃণমূল থেকেই সব থেকে বেশি নেতা-কর্মীরা গেরুয়া শিবিরে ভিড় জমায়। ফের যে দল বদলের ঝড় তা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ।

২০১১ সালে যখন হাজার হাজার মানুষ বাম ও কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ  দিয়েছিলেন তখন যিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন পরবর্তীতে তিনিই আবার যারা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যান, তাদেরকে ‘চোর’ মূল্যায়ন করেন। শুধু তাই নয়, দল ভাঙানোর মূল কারিগর মুকুল রায় যখন তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেন তাঁকেও ‘গাদ্দার’ আখ্যায়িত করেন তিনি। প্রসঙ্গত, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের একঝাঁক নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন৷ বিজেপি হেরে যাওয়ায় মুকুল রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী দত্তের মতো নেতারা আবার ঘাসফুল শিবিরে ফিরে এসেছেন৷ আর এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং। তিনিও সম্প্রতি বিজেপি ছেড়ে চলে এসেছেন তাঁর পুরনো দল তৃণমূলে। এই ঘটনা বঙ্গ বিজেপির পক্ষে যে বিরাট ধাক্কা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানেই কি শেষ? পদ্ম শিবির ছেড়ে পুরনো দলে ফিরে এসেই অর্জুন জানিয়েছেন, বিজেপির জন্য আরও বড় ধাক্কা ও ভাঙ্গন অপেক্ষা করছে। ব্যারাকপুরের সাংসদের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘ওয়েট অ্যান্ড সি। আরও অনেকে আসবে’ দল বদলের জল্পনাকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। কেবল তাই নয়, বিজেপি ছেড়ে কারা তৃণমূলে যোগ দিতে চলেছেন, সেই তালিকাও নাকি অর্জুন তৈরি করে ফেলেছেন। যদিও তিনি তাঁদের নাম প্রকাশ্যে আনেননি। উল্লেখ্য বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রবল সমালোচক জয়প্রকাশ মজুমদার৷কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন এই নেতা৷ জয়প্রকাশকে বিজেপি সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছিল৷ তারপর তিনি তৃণমূলে যোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে৷

রাজনীতির আলোচকরা বলেন, অধিকাংশ নেতা-কর্মীর দল বদলের পিছনে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থই অনেক বেশি গুরুত্ব পায়, তাই বার বার এই দল বদলের ঘটনা ঘটছে। আর বাংলায় বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের আকার ও সমৃদ্ধি বাড়াতে দল বদলকেই সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।বাংলা ছাড়া জাতীয় রাজনীতিতেও দলবদলের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে৷ দলবদলু নেতারা ভোটে জিতছেন৷ প্রশ্ন তাহলে কি রাজনীতিতে আদর্শ ও বিশ্বাসের গুরুত্ব কমছে?
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version