লেখক লিখেছেন আর সেটাই পরে ঘটেছে, একবার নয়, একাধিকবার এমনটা হয়েছে।পাঠক যেমন বইটি পড়ে বিস্মিত হয়েছেন, পরবর্তীতে বিশ্ববাসী আরও অবাক হয়েছেন লেখকের কল্পনাশক্তিতে। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় মরগান রবার্টসনের ‘দ্য রেক অব দ্য টাইটান’

৮০০ ফুট লম্বা এবং ৪৫ হাজার টন ওজনের একটি জাহাজ। যেটি ডুববে না বলা হয়েছিল। এপ্রিলের এক রাতে সেই জাহাজে ঘুমিয়ে ছিল ২৫০০ যাত্রী। কিন্তু বরফের সঙ্গে ধাক্কা লাগে জাহাজটির এবং জাহাজটি ডুবে যায়। পর্যাপ্ত লাইফবোট না থাকায়, অনেক যাত্রীর মৃত্যু হয়। গল্পটি বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজের ডুবে যাওয়ার গল্প হলেও এটি টাইটানিকের গল্প নয়। এটি টাইটানিক ডুবির ১৪ বছর আগে লেখা ‘টাইটান’ ডুবে যাওয়ার গল্প। আর সেই জাহাজের নাম ছিল ‘টাইটান’!

১৮৯৮ সালে, মরগান রবার্টসন ‘দ্য রেক অব দ্য টাইটান : অর ফিউটিলিটি’ নামে একটি বই লেখেন। গল্পটি ছিল জন রোল্যান্ড নামের একজন মদ্যপ এবং নিন্দিত নৌ-অফিসারকে নিয়ে। যিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ ‘টাইটান’-এর দায়িত্বে। রবার্টসন লিখেছিলেন এই জাহাজের ‘ডুবে যাওয়া সম্ভব নয়’। কিন্তু টাইটানও বরফের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় এবং বিশ্বের অন্যতম ট্র্যাজিক ঘটনায় পরিণত হয়।

টাইটান লম্বায় ছিল ৮০০ ফুট, টাইটানিক ৮৮২ ফুট। টাইটান যখন বরফের গায়ে ধাক্কা খায়, তখন জাহাজের দড়িতে ২৫টি গিঁট ছিল, টাইটানিকের ছিল ২২টি। টাইটানে যাত্রীসংখ্যা ছিল ২৫০০, টাইটানিকের ২৫০০। ব্রিটিশ মালিকানাধীন দুটি জাহাজই মাঝরাতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। জাহাজ দুটি নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে ৪০০ নটিক্যাল মাইল দূরে নর্থ আটলান্টিকে ডুবে যায়। দুই জাহাজেরই লাইফবোটের সংকট ছিল, টাইটানের ছিল ২৪টি, টাইটানিকের ছিল ২০টি।

মিল থাকলেও কিছুটা টাইটানডুবিতে বেঁচে যায় ১৩ জন, টাইটানিকে বেঁচে ফিরেছিল ৭০৫ জন যাত্রী। টাইটান বরফের গায়ে ধাক্কা লেগে উলটে গিয়েছিল, টাইটানিক দু টুকরো হয়ে যায়। টাইটানিক দুর্ঘটনার পর রবার্টসনকে বাস্তবতা এবং গল্পের মিল নিয়ে ক্ষ্যাপাটে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন : জুল ভার্ন

সবাই জানেন এটি একটি সায়েন্স ফিকশন, কল্পবিজ্ঞান কাহিনির ভবিষ্যতের শহর, সমাজ, প্রযুক্তি অনেক সময়েই বাস্তবে হয়ে থাকে, তবে এমন প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে এমন গল্প কীভাবে লেখা সম্ভব হয়েছিল।১৮৬৫ সালে ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দা মুন’ নামক বইয়ে তিনি পৃথিবী থেকে চাঁদে যাওয়ার একটি যন্ত্রের কথা বলেন। সেই গল্পে তিনি লিখেছিলেন, কীভাবে ‘কলাম্বিয়াড’ নামক একটি মহাকাশযানে চড়ে পৃথিবী থেকে তিনজন নভোচারী চাঁদে গেলেন এবং নিজের গ্রহে ফিরে এলেন। সেই মহাকাশযান চালানোর জন্য তিনি বিশাল একটি যন্ত্রের পরিকল্পনাও করেছিলেন, যেগুলো প্রোজেক্টাইলকে অভিকর্ষের বাঁধা পেরিয়ে পৃথিবীর বাইরে নিক্ষেপ করবে। ফিরতি পথে তাদের নভোযানটি প্রশান্ত মহাসাগরে এসে পড়ল সেই নিয়েও লিখেছিলেন জুল ভার্ন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই লেখা প্রকাশের ঠিক ১০৪ বছর পর ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই সত্যি সত্যি পৃথিবী থেকে অ্যাপোলো-১১ নভোযানে চড়ে চন্দ্রাভিযানে যান তিনজন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স। চন্দ্র জয় শেষে তারা ফিরে আসেন পৃথিবীর বুকে। গল্পের কাহিনীর মতো তাদের নভোযানটিও প্যারাসুটের সাহায্যে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে।

দ্য ন্যারেটিভ অব আর্থার গর্ডন পিম অব নানটুকেট : এডগার অ্যালান পো

১৮৩৮ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের মূল চরিত্র জাহাজের চারজন বিদ্রোহী নাবিককে একটি নৌকায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নৌকায় ভাসতে ভাসতে যখন খাদ্য ও জলের অভাবে সবার অবস্থাই খুব খারাপ, তখন টস করার প্রস্তাব দেয় রিচার্ড। টসে যে হারবে, তাকে হত্যা করে বাকিরা খাবে। বন্ধুদের বাঁচাতে রিচার্ড ইচ্ছা করেই টসে হেরে গেল এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করল। সেই সময় বইটি পড়ে নিছক কাল্পনিক বলে মনে করা হলেও এমন ঘটনাই ঘটলো ৫০ বছর পর। ১৮৮৪ সালে ইংল্যান্ডের ইয়টে এমনই একটি ঘটনা ঘটে। সাউদাম্পটন থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে ৫২ ফুট ইয়টটি সাগরে নিমজ্জিত হলে লাইফবোটে উঠে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয় ৪ জন নাবিক। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এদের মধ্যে একজনের নাম ছিল রিচার্ড পার্কার। ১৭ বছর বয়সী সেই কিশোরকে হত্যা করে তার শরীরের মাংস খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে তার সঙ্গীরা। বইয়ের পাতার গল্পের সঙ্গে বাস্তবে এভাবে মিলে যাওয়ার ঘটনা সত্যিই বিস্ময়ের।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version