তপন মল্লিক চৌধুরী

একটি দেশের সংবিধানের ধারায় লেখা রয়েছে, "সব মানুষেরই সুখী হওয়ার অধিকার রয়েছে।" তারপরেই আবার লেখা রয়েছে,"সব মানুষেরই অসুখী হওয়ার অধিকার রয়েছে।" শুধু কি মানুষের কথা লেখা আছে কুকুর-বিড়ালদের কথা। সংবিধানের একটি ধারায় লেখা রয়েছে, "একটি কুকুরের কুকুর হওয়ার অধিকার রয়েছে।" তারপরেই অন্য ধারায় লেখা রয়েছে, "কোনো বিড়ালই তার মালিককে ভালোবাসতে বাধ্য নয়, তবে বিপদের সময় তাকে অবশ্যই সাহায্য করতে হবে।"

এই দেশটির সংবিধানে মোট ৪১টি ধারা রয়েছে, যেগুলিতে দেশটিরস্বাধীন মতামতের অধিকার ও আদর্শের ছবি ফুটে উঠেছে। যেমন- এক জায়গায় বলা হয়েছে, “সকলেরই মৃত্যুবরণের অধিকার রয়েছে, কিন্তু এটি কোনো বাধ্যতামূলক বিষয় নয়।” আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, “প্রত্যেকেরই বোঝার অধিকার রয়েছে।” কিন্তু তারপরেই যখন দেখা যায়, “প্রত্যেকেরই কোনো কিছু না বোঝার অধিকার রয়েছে।” তখনই অবাক হতে হয়। সংবিধানের ধারাগুলি পড়ে আশ্চর্য হওয়ারই কথা, তবে আরও আশ্চর্য হতে হয় সংবিধানের ধারাগুলি লেখা আছে যেখানে তা জেনে- রাস্তার ধারের দেওয়ালে।

না, কোনও বানানো গল্পকথা নয়, নিজস্ব সংবিধানই ছাড়াওএই দেশটিতে রয়েছে নিজস্ব রাষ্ট্রপতি, সরকার, মুদ্রা, এমনকি তিন-চারটি নৌকাসমেত নৌবাহিনীও। অন্তত কিছুদিন আগে পর্যন্ত দেশটির ১০ সদস্য বিশিষ্ট সেনাবাহিনী ছিল। কিন্তু শান্তিপ্রিয় দেশটি কারও সঙ্গে কোনও বিবাদে জড়াতে ইচ্ছুক নয় বলে সেই সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এই দেশটির নাম দ্য রিপাবলিক অফ উজুপিস।ইউরোপে যতগুলিক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেশ আছে উজুপিস সেগুলির মধ্যে একটি। দেশটির আয়তন ১ বর্গ কিলোমিটারেরও কম।১৯৯৭ সালের ১ এপ্রিল লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াস থেকে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে।আচমকা একদিন এই শহরের বাসিন্দারা স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে বসে। তারা লিথুনিয়ার শিল্পমনস্ক মানুষ।

লিথুনিয়া হল তিনটিবাল্টিক রাষ্ট্রের মধ্যে একটি। অন্য দুটি হল এস্তোনিয়া ও লাটভিয়া। ১৯৪৪-৯০ পর্যন্ত দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত একটি রাষ্ট্র ছিল। স্বাধীন দেশটির একেক ঋতুর জন্য একেক রঙেরচারটি জাতীয় পতাকা রয়েছে। আয়তনের দিক থেকে উজুপিসকে দেশ না বলে এলাকাও বলা যায়। তবে একটি স্বাধীন দেশের মতোই আচরণ করে আসছে। যদিও বিদেশী সরকারগুলো কখনোই উজুপিসকে স্বাধীন দেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তবু এই উজুপিসই এখন ভিলনিয়াস সহ সমগ্র লিথুনিয়ার গৌরবের উৎস। এক সময়ে ভিলনিয়াস জুড়ে অসংখ্য সোভিয়েত নেতার মূর্তি গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেসব মূর্তিভেঙে ফেলা হয়। ফাঁকা পড়ে থাকে কেবল সেগুলির স্তম্ভ।

সব কিছুর মতো উজুপিসের প্রশাসনিক কাঠামো ও কাজকর্ম বেশ হালকা।প্রথমত; দেশটির সংসদ ভবনটি একটি ক্যাফে-কাম-পাব। ডজনখানেক মন্ত্রী দেশটির সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। যারা রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান, তাদের স্থানীয় সংগঠনগুলির সদস্য হতে হয়।

আশ্চর্যের বিষয় এই ভাবেই বিগত ২১ বছর ধরে দেশটি সফলভাবে চলছে।আর এতগুলি বছর ধরে দেশের রাষ্ট্রপতি তার নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন। যদিও তিনি প্রায়ই কৌতুক করে বলেন, এবার তার একটু বিশ্রাম দরকার। তারপরও প্রায় প্রতি সপ্তাহের সোমবার তিনি মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, বাইরের দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।

যদিও আন্তর্জাতিকভাবে কোনো স্বীকৃতি মেলেনি উজুপিসের। লিথুনিয়া সরকারও তা নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নয় বরং রাজধানী ভিলিনিয়াস এবং লিথুনিয়ার কাছে এটি রীতিমতো গর্বের বিষয়।তবে লিথুনিয়া কিংবা অন্য যে কোনো দেশের পর্যটকদের উজুপিসে প্রবেশের জন্য কোনো ভিসা-পাসপোর্টের প্রয়োজন না হলেও প্রজাতন্ত্র দিবসের বেলায় নিয়মটা একটু বদলে যায়। এই দিন উজুপিসে প্রবেশ করতে হলে সঙ্গে থাকতে হবে পাসপোর্ট।

Share.

4 Comments

  1. debarshi mandal on

    খুব মজা পেলাম লেখাটি পড়ে, তার সঙ্গে অনেক কিছু জানা গেল। লেখককে ধন্যবাদ।

  2. bishwanath ray on

    অসামান্য একটি ফিচার স্টোরি পড়লাম, এই লেখকের আরও লেখা আগে পড়েছি অন্য পাতায়। এমন আরও লেখা পড়তে চাই। লেখা যেন নিয়মিত প্রকাশ পায়।

  3. krishnapriyo dasgupta on

    লেখাটি পড়েই দেশটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে গেল, লেখা তো এমন হওয়াই উচিত যা পাঠকের খিদে বাড়ায়।

Leave A Reply

Exit mobile version