সময়টা সাতের দশকের একেবারে শেষ দিকের। বীরভূম জেলার সমস্ত গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। রাত-বিরেতে চোর-ডাকাতের ভয়ও আছে। বীরভূম জেলাতেই আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। সেই সময় থেকেই আমার একটি নেশা মাথার মধ্যে কিলবিল করত। বীরভূম জেলায় যতগুলি গ্রাম আছে, সবগুলি আমি ঘুরব। তার পর রাঢ়বঙ্গের গ্রাম আর তার পর পশ্চিমবঙ্গের। এই গ্রাম ঘোরার নেশায়ে আমি আচ্ছন্ন থাকি। আজও। গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে কত মানুষ দেখেছি, কত রকমের চিন্তা-চেতনা তাঁদের, কত রকমের মুখ ও মুখোশ তাঁদের। গ্রামের প্রকৃতি, গ্রামের ঘরবাড়ি, গ্রামীণ মানুষের জীবন-যাপন, গ্রামীণ সংস্কৃতি, আলকাপ-যাত্রা-সঙ-বোলান-ভাদু-ভাজো-টুসু-মনসা-কাহানি-রুব্বান-রায়বেঁশে দেখেছি, শুনেছি। ৫০ বছর সেই নিয়ে থেকেও এই ৬৩ বছরে এসে যখন পিছন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় যা দেখেছি, যা শুনেছি তার ১০ শতাংশও লিখে উঠতে পারিনি। ৪০ বছর আগের সে গ্রাম আজ আর নেই। থাকার কথাও নয়। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সবই বদলে গিয়েছে। তখনকার কম শিক্ষিত মানুষরা আজকের মতো এত জটিলও বোধ হয় ছিল না। এটা অবশ্যই আমার মনে হওয়া। আমার উপলব্ধি।

তবু গ্রাম সমীক্ষায় যেখানে গিয়েছি, কেউ না-কেউ থেকেছেন আমার সঙ্গে। প্রথম দিকে বীরভূম জেলার গ্রামের রাস্তা এত খারাপ ছিল যে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। তা বলে তো গ্রাম ঘোরা থেমে থাকবে না! ছিলও না। এই পথ চলাতেই আমার আনন্দ, আমার বিষাদ। অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি সেখান থেকে।
একদিন এক গ্রামে যাচ্ছি। সঙ্গে লোকগীতিকার অনিল চক্রবর্তী। আমি যুবক, তিনি ষাটের ধারে। সন্ধ্যা নেমে আসছে ময়ূরাক্ষীর চরে। দু’-চারটে শেয়াল ডাকা শুরু করেছে। নদীর বালিতে বালিতে হাঁটছি আমরা দু’জন। হেঁটেই চলেছি। উনি অক্লান্ত। বলেন- “এই তো নদীর বালি থেকে উঠেই আবডাঙার ঘাট। সেখানেই জিপ পেয়ে যাব। আর হাঁটতে হবে না। এই আবডাঙার গল্প নিয়েই তারাশঙ্কর বাবু উপন্যাস লিখেছেন, ‘চাঁপাডাঙার বউ’। ওই হানাবাড়ির মতো বাড়িটি দেখা যাচ্ছে না, ওই বাড়িরই ঘটনা। এই আবডাঙা পেরিয়েই ‘ধনডাঙা’। চলেই এলাম আর।”
‘আমড়া-গণুটিয়ার ঘাটে’ চীপ সাহেবের কুঠি পেরিয়ে ময়ূরাক্ষী নদীর বালিতে হেঁটে আমরা যখন আবডাঙার ঘাটে উঠেছি, তখন শেষ জিপটিও চলে গিয়েছে লাভপুর। হাঁটো দশ মাইল, ধনডাঙা। কার্তিক দাস বাউলের বাড়ি।

সে গ্রামে যখন আমরা পৌঁছলাম তখন রাত্রি দশটা। শীতের রাত। বাংলার গ্রাম ঘুমে আচ্ছন্ন। শুনলাম আমাদের আসার কথা শুনে এক বৃদ্ধা আমাদের রাতের খাবারে নেমতন্ন করেছেন। সেই বৃদ্ধার চাকুরে ছেলেরা বাইরে, শহরে থাকে। তিনি এখানে একা। বয়স সত্তরের বেশি। তাঁর বাড়ি গেলাম রাত সাড়ে দশটায়। সবার বাড়িতে খিল। চুরির ভয়। কার্তিক আমাদের পৌঁছে দিল সেখানে। লম্বা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা উঠোন, টিনের দোতলা বাড়ি। চাতালে একটি চ্যারাকবাতি, চারকোণা কাঁচের টিনের মোড়কে মোড়া বাতিটি নিয়ে বসে আছেন তিনি। আমরা যেতেই, প্রায় অন্ধকারেই উঠে তিনি আলুপোস্ত, মাছের ঝোল, চাটনি ইত্যাদি দিয়ে ভাত দিলেন। আমরা পরম তৃপ্তিতে খেলাম। তিনি কেন আমাদের খাওয়ালেন জিগ্যেস করিনি। তাঁর নামটিও আজ অবধি জানি না! খাওয়া হলে চলে এসেছিলাম কার্তিকের বাড়িতে।
আসলে মায়ের কোনও নাম হয় না। সন্তানকে খাওয়াতে তাঁর কোনও কারণও লাগে না। বাংলার গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে মায়েরা ছিলেন, আছেন, থাকবেন। এ বিশ্বাস থেকে কি আমাকে সরানো যাবে? আমি যে দেখেছি ‘ধনডাঙা’ গ্রামের সেই ‘মা’কে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version