গত কয়েকমাস নাওয়া খাওয়ার সময় ছিল না। এক টানা গড়েছেন মৃন্ময়ী মাকে। বিজয়ায় সেই মূর্তি বিসর্জন হয়েছে। একটু জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে মৃৎশিল্প কালাম পটুয়া মাটি আর তুলি ছেড়ে কলম ধরলেন। প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বুকে বিধে থাকা ক্ষতের মতো প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন……

আমাদের বাড়িতে খুব ছোট থেকে প্রতিমা নির্মাণ দেখে এসেছি। মেজ কাকা বৈদ্যনাথ পটুয়া, একাধারে মৃৎশিল্পী ও পটচিত্রশিল্পী। বাবা ভোলানাথ পটুয়া এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল না।

কাঠ ও বাঁশের কাঠামো, বেড়া, বাঁশ, দড়ি দিয়ে ভার বাঁধা, এক মৃত্তিকা, দ্বি মৃত্তিকা, ত্রি মৃত্তিকা প্রতিমা। রং ছাড়া বাকি কাজ বাড়িতেই। সারিবদ্ধ ভাবেই থাকতো সরস্বতী, কার্তিক, বিশ্বকর্মা, কালী। বাড়িতেই সমস্ত কাজ করা হত। কেবল দুর্গা প্রতিমার জন্য বাইরে যেতে হতো।

এই মূর্তির কাজে বাড়ির সকলে যুক্ত থাকতো। আগে রংয়ের কোন পাউডার পাওয়া যেত না। তরল ভাদালারা কার্ড পাওয়া যেত এবং তা মাটি জ্বালা তাওয়াতে জলসহ ঘষে ঘষে তৈরি হতো। মা কাকিমার এই কাজ ছিল রাত্রে খাবার পর, পর দিন সকালে পৃথক হয়ে যাওয়া জল রং ও সর্বনিম্নে পড়ে থাকা বালির অংশ পৃথক করা হতো। পরে রংয়ের সঙ্গে আঠা মিশিয়ে রং বানানো হতো। আঠা হিসেবে তেতুল বীজ, বেলের আঠা, কচুর লালা বা ডিম।

আমার যখন ষষ্ঠ শ্রেণি, প্রথমবার কাকা আমাকে নিয়ে গেলেন দুর্গা প্রতিমা নির্মাণে সহযোগিতা করার জন্য। বেশ কয়েকটি প্রতিমা ধরেছেন, যা একলা কাকার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়।

ততক্ষনে কাকার মনে হয়েছে, আমি সহযোগিতা করতে পারব। কাকা ও দাদার মাধ্যমে হাতে খড়ি বলতে যা, তা হয়ে গেছে। কখন আটকে গেলে কাকার কাছে শুধরে নিতাম। ছবিতে জল রং লাগানো শুরু করেছি সবই পটের ছবি। মাঝে মাঝে মহাপুরুষদের ছবি আঁকতে শুরু করেছি। ছবি দেখে কাকা মুচকি মুচকি হাসতেন। তাতেই আমার আনন্দ সীমাহীন, যেন নিঃশব্দ প্রশংসা পেয়ে গেছি।

কাকার নির্ভরতা বেড়েছে ততদিনে, ভরসা করতে পেরে নিয়ে যেতে চাইলেন। মা একটু দ্বিধা করে বলে, ও কি পারবে? তারপর খাওয়া-দাওয়া থাকা। কাকার আশ্বাসে মা আর উচ্চবাচ্য করেননি।

সেবার প্রতিমার গায়ে খড়িমাটি সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়ার কাজে দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। সহজ কাজ করি মাটির সাদা রং শুকালে অন্য রং হতে পারে তার আগে নয়। শেষে ‘ঘামতেল’ (বার্নিশ) দিয়ে প্রতিমার রং এর সমাপ্তি।

যাদের নিজস্ব বাড়ির পুজো তাদের বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বারোয়ারি পুজোতে পালা করে অনেকের বাড়িতে খাওয়া, সব কিছু নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। কখনো কখনো কাকা এক বাড়িতে, আমি এক বাড়িতে খেতে যেতে হতো, যা আমার কাছে একা খেতে যাওয়া খুবই বিরক্তের বিষয় ছিল। তার ওপর বেশিরভাগ বাড়িতে খাবার পাতা ফেলা ও খাবার জায়গা গোবর দিয়ে নিকাতে হতো, ভারি অভিমান ও অপমানিত বোধ করতাম। কিন্তু আমি না গেলে কাকা বিপদে পড়বেন বলে যেতে হতো। মাকে সব বলতাম ফিরে, কোন কোন বাড়ির রান্না মনে রাখার মতো সুস্বাদু থাকতো। মা বলতেন, আর যেতে হবে না। নিষেধ করে দেব।
বাবা খুব রাসভারি, সুঠাম লোক ছিলেন। আমার সবকিছু ঘিরে মা। বাবা চাষাবাদ ও পশু চিকিৎসা করতেন। বই পড়া খুব নেশা ছিল।

সম্ভবত তৃতীয়বার কাকার সঙ্গে গেলাম ঠাকুর গড়তে। ততদিনে খড়িমাটির প্রদিপ সহ অন্যান্য রং ব্যবহারের অনুমতি মিলেছে। চোখ ফোটানো সহ আরো একটি কঠিনতম কাজ ছিল, যেটা কাকা আমাকে কিছুতেই করতে দেবেন না, সেটা হল সমস্ত রং এর কাজ শেষ হলে পুরো প্রতিমার গায়ে সাগু-আঠার প্রলেপ দেওয়ার। কারণ এই আঠা  লাগালে ঘাম তেল লাগানো যায় না। কোথাও এই আঠা এড়িয়ে গেলে লাগালে কালো হয়ে যায়। এই কাজের অনুমতি না মেলায় নিজেকে বেশ অসফল মনে হতো।

একদিন কাকা আমাকে প্রতিমার কাছে রেখে স্নানে গেলেন। বললেন, এই আঠা কুকুরে খেয়ে না ফেলে। আমি স্নান করে এসে লাগাব। তারপর খেতে যাব।

আমি ভাবলাম, এই সুযোগ। মা সরস্বতী কে স্মরণ করে শুরু করলাম আঠা লাগানোর কাজ। কাকার ভয়, এইজন্য যে চোখে কালো রং আছে। জল মিশ্রিত সাগু একটু বেশি পড়লে মুখটা কালিতে নষ্ট হয়ে যাবে। কাকা ফিরে এলেন, বসলেন, একটা বিড়ি খেয়ে নিজেকে চার্জ করে নিয়ে সাগু আঠার জায়গা ও তুলি চাইলেন। আমি বললাম দেখতে পাচ্ছি না। কাকা তরাক করে উঠে হাজার জায়গা দেখে আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, যা ভাবছিলাম, তাই, কুকুরে খেয়েছে। এখন কিভাবে সামলাবো, সময় নেই। আমি বললাম মায়ের দিকে দেখো। কাকা তাকালেন, প্রতিমার  দিকে। তখনও টাটকা, শুকায়নি। তৃপ্তির অমলিন হাসি দেখলাম দ্বিতীয়বার কাকার মুখে।

অনেকগুলো প্রতিমা। দিনরাত এক করে দুজনে কাজ করেছি। কাকা খুব ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছেন। রাত তখন দুটো। বাচ্চাদের ঠাকুর দেখার ভিড় নেই। গ্রামে সব মানুষ অঘোর ঘুমে বিভোর একজন বললে, কালিকোর ( কারিগর) রাত পোহালেই ষষ্ঠী। দেখে তো মনে হচ্ছে না, কাজ সারতে পারবেন। কি হবে আর। বিড়বিড় করতে করতে বিড়ি টানতে টানতে চলে গেলেন। আমি কাকাকে বললাম, এমন বললেন কেন? কাকা বললেন, ষষ্ঠী শুরু হলে আমাদের প্রতিমার গায়ে হাত দিতে দেবে না। আমরা যে এত মাস ধরে তিলে তিলে কাজ করেছি! মাটির তাল থেকে ধাপে ধাপে গড়েছি দেবীর মূর্তি! কাকা রইলেন নিরুত্তর।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version