সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ১৬ হাজার ফুট উপরে একটি লেক। ১৩০ ফুট চওড়া এবং ১০ ফুট গভীর লেকটি শীত ও গ্রীষ্মের আবহাওয়ার ভিত্তিতে ছোট-বড় হয়। হিমালয়ে অবস্থিত এই লেকটির নাম রূপকুন্ড। তবে বাকি আর পাঁচটা লেকের থেকে এটি বেশ আলাদা। রহস‍্যে ঘেরা এই লেকটির ইতিহাস জানা যায় ১৯৪২ সালে এক ব্রিটিশ বনরক্ষী হিমালয়ের ত্রিশূল পর্বতমালার শৃঙ্গে এই রহস্যজনক লেকটির সন্ধান পান।

উত্তরাখন্ডের লোকগাথা অনুযায়ী বহুকাল আগে বতর্মান উত্তরাখন্ডের চামেলী জেলার নৌটি গ্রামে বাস করতেন স্বয়ং মহাদেব পত্নী নন্দাদেবী। একবার তিনি শ্বশুরবাড়ি রওনা দেন শোভাযাত্রা নিয়ে। পথে নন্দাদেবীর ভীষণ তৃষ্ণা পায়। অথচ ত্রিসীমানায় কোনো জলের চিহ্ন ছিল না। তৃষ্ণার্ত নন্দাদেবী মহাদেবকে স্মরণ করেন। মহাদেব তখন দৈববলে তার তৃষ্ণার্ত স্ত্রীর জন‍্য তৈরি করেন এক ছোট্ট হ্রদ বেদিনী কুন্ড। নন্দাদেবী ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা সেই জল পান করে তৃষ্ণা মেটান। রাস্তায় আবার তৃষ্ণা পেতে পারে সেই কথা ভেবে মহাদেব যাত্রাপথে আরো একটি হ্রদ তৈরি করেন যা রূপকুন্ড হ্রদ নামে পরিচিত।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই জনমানব শূন্য এলাকায় এতগুলো কঙ্কাল এলো কিভাবে? এলাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী যে গ্রাম সেখানে যেতেও সময় লেগে যায় প্রায় পাঁচদিন। তাহলে এতগুলো মানুষের দেহাবশেষ এখানে এলো কিভাবে? কারা নিয়ে এলো এদের? কেনোই বা তারা একসাথে এখানে আসলো প্রাণ দিতে? প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা আছে, আবার নেই’ও। অর্থাৎ এই রহস্যের সঠিক ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি।

কঙ্কালগুলো এতই পুরনো যে কিছু কিছু কঙ্কাল নিজেই বরফের মমিতে পরিণত হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘসময়ে বরফে চাপা থাকার কারণে এগুলো একেবারে অক্ষত রয়েছে। ১৯৫৬ সালে কলকাতার এক নৃতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা সিদ্ধান্ত নেয় তারা রূপকুন্ড লেকের দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণা করবেন। সেই উদ্দেশ্যে ত্রিশূল পর্বতে যাত্রাও করেন। কিন্তু তুষার ঝড়ের কারণে বানচাল হয়ে যায় তাদের সেই যাত্রা। কয়েকমাস পর তারা আবার একই উদ্দেশ্যে কঙ্কাল হ্রদে গিয়ে কঙ্কালের নমুনা নিয়ে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু সেইসময় কার্বন ডেটিং গবেষণা এতটা উন্নত ছিলনা বলে সেই ফলাফলগুলো খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

গরমকালে উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেকের বরফ গলতে শুরু করে। এরপরেই লেকে ভেসে উঠতে দেখা যায় মানুষের কঙ্কাল। আর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই হ্রদের নাম কঙ্কাল হ্রদ। এই হ্রদ থেকে মোটামুটি ৮০০ টি কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এর মধ‍্যে ৩৮ টি কঙ্কালের ডিএনএ রিপোর্ট তৈরি করেন। তাদের গবেষণায় জানা যায় কঙ্কালগুলি মোট তিনটি জিনগত স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর অন্তর্গত। তাঁরা কমপক্ষে দুটি তরঙ্গে মারা যায় তাও প্রায় ১০০০ বছরের ব‍্যবধানে। গবেষণায় এও বোঝা গিয়েছে কঙ্কালগুলি যেই মানুষদের তারা বেশ শক্তিশালী এবং লম্বা গড়নের ছিল।

২০০৪ সালে ন‍্যাশানাল জিওগ্রাফির তথ্যচিত্র অনুযায়ী এই দলগুলি কোনো মহামারীতে মারা যায় নি। কারণ ডিএনএ বিশ্লেষণে কোনওরকম ব‍্যাকটেরিয়া সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। আবার এই মৃতদেহগুলি কোনো যুদ্ধের ফলাফল হিসাবেও ধরা যায় না। তার কারণ ওই মৃতদেহগুলির সঙ্গে কোনো অস্ত্রর হদিশ মেলেনি। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করেছেন হয়তো কোনো ব‍্যবসায়িক দল সেই পথে প্রাকৃতিক দূর্যোগের শিকার হয়ে মারা গিয়েছে। যদিও রূপকুন্ড কিন্তু কোনো বাণিজ‍্য পথে পড়ছে না। পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নৃবিজ্ঞানী ক‍্যাথলিন মরিসন বলেছেন, যখন এক স্থানে আপনি প্রচুর মৃতদেহ একসাথে দেখতে পাবেন, ধরে নিতে পারেন সেটি আসলে একটি কবর স্থান। আসলে সেইভাবে কিন্তু কোনো সঠিক সম্ভবনাই আঁচ করা যায়নি এখোনো। তবে রূপকুন্ড হ্রদে ভেসে ওঠা কঙ্কালগুলি নিজের চোখে দেখলে হৃদয় কেঁপে যেতে বাধ‍্য।

সবকিছু পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা একটি অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। শত শত তীর্থযাত্রী এক ভয়াবহ শিলাবৃষ্টির কবলে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। শিলাবৃষ্ট সাধারণত প্রাণঘাতী হয় না। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত নিয়মে সেদিন হয়তো শিলাবৃষ্টির সাথে পড়া শিলাগুলোর আকার অনেক বড় ছিল। যাত্রীদের কাছে কোন ছাউনি ছিল ছিল না, যা তাদেরকে করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি করে দেয়। আর প্রায় ১২০০ বছর আগের সেই ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে আজো রূপকুন্ডের কঙ্কাল হ্রদের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে শত শত কঙ্কাল।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version