মাস খানেক আগেই বিদায় নিয়েছে বর্ষা। নীল আকাশে জমতে শুরু করেছে ছেড়া ছেড়া সাদা মেঘের টুকরো। আর কিছুদিন বাদেই পুজো। বাতাসও যেন সেই বার্তাই বয়ে আনছে। তখন শুক্ল পক্ষ। জ্যোৎস্না মাখা সন্ধ্যায় সবাই মিলে গিয়ে বসলাম বিচেই। রুপালি আলোয় মুড়েছে সমুদ্র সৈকত। সে আলোর প্রতিফলনেই ঠাহর করা যাচ্ছে জলের দূরত্ব।

দিনের পাখিরা বাসায় ফিরেছে। মাঝেমধ্যে রাতের পাখিদের ডাক ছাড়া গোটা এলাকাতেই তখন নিঝুম। ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে আসছে কিছু আলো। ওটাই দিন দুয়েকের জন্য আমাদের থাকার আস্তানা।
কেউ দিল্লি তো কেউ পুনে। বেশিরভাগই অবশ্য কলকাতার বাসিন্দা। কেউ সরকারি তো কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কেঊ বা আবার নিজের মতো করেই খোঁজার চেষ্টা করছে নিজের পথ। সম্পর্কগুলো পুরানো। তবু সব সময় দেখাসাক্ষাৎ হয়ে ওঠেনা সঙ্গত কারণেই। সেবার মিলেছিলাম দিন দুয়েকের জন্য। সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নিতে খুঁজছিলাম নির্জনতার আশ্রয়। পথ হারিয়ে নয়, তাই দিঘা, মন্দারমনির কোলাহল এড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম পূর্ব মেদিনীপুরেরই এক প্রায় অপরিচিত বিচ বাকিপুটে। জায়গাটা জুনপুটের কাছে। কাঁথি থেকে দূরত্ব সাকুল্যে ১০ কিলোমিটার। সে সন্ধ্যায় দরাজ গলায় গান ধরলো রাজা। ‘ মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকালো মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে…’
সে গান থামতেই ও ধরলো, ‘ তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা/ তুমি আমার সাধের সাধনা।’ টিমে কয়েকজন খুদে সদস্যও ছিল। প্রথমটায় তারা গভীর মনোযোগ সহকারে পরখ করছিল বাবা, মা, কাকু, কাকিমাদের রকমসকম। তারপর তাদেরই একজন বলে উঠলো, আমিও একটা কবিতা বলতে চাই। বলেই সে শুরু করলো, ‘ রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা তার ওপরে বসলো রাজা/ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা গিলছে কিন্তু খাচ্ছে না..’ আড্ডা যতই জমাটি হোক না কেন, রাত বাড়ছে।


সমুদ্র কিনার মানেই মাছের দেশ। এমন জায়গায় হরেক কিসিমের মাছ না খেলে চলে ? সে আশ অবশ্য পূর্ণ হয়েছে দুপুরেই। আগে থাকতেই বুকিং ছিল। সঙ্গে দুপুরের খাবারের অর্ডার। ডাল, ভাত, আলুভাজা, সব্জি, গলদা চিংড়ির মালাইকারি আর সর্ষে পমপ্রেট। বিকেলের স্ন্যাক্স-এ পেয়াজি কিংবা ভেজ আর চিকেন পকোড়ার সঙ্গে চা থাকেই। বিকেলে দেখেছিলাম ঘরমুখো জেলেরা মাছ ধরে ফিরছে। ওদের জালে ধরা পড়েছিল খান কতেক ছোট ইলিশ। তাই আনা হয়েছিল। কেয়ারটেকার আর রান্নার ঠাকুরকে বলে কয়ে সে কখনা মাছও ভাজিয়ে নেওয়া হয়েছিল। রাতে অবশ্য তত বিলাসীতার সুযোগ নেই। ভাত বা রুটির সঙ্গে মুরগির ঝোল আর স্যালাড। ডাল, সব্জিও থাকে বটে। তবে আমরাই চাইনি। যা হবে দেখা যাবে পরদিন।
নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করছিলাম, দিঘা, পুরী, চাঁদিপুরের হোটেলেও আমরা প্রাইভেট বিচ দেখেছি। কিন্তু সেটা মূলত আবাসিকদের স্নানের জন্য খানিকটা ঘেরা এলাকা। কিন্তু বাকিপুটের অভিজ্ঞতা যেন সম্পূর্ণ আলাদা। সমুদ্র পারের গোটা একটা এলাকা। সকাল থেকে রাত, গোটা এলাকাটিতে শুধু এবং শুধুমাত্র আপনারাই। আর থাকে লাল কাঁকড়ার দল। আশেপাশের জনবসতি নেই। থাকার রিসোর্টও একটাই। বিচ আর রিসোর্টের মাঝে একটা ঝাউবন। রিসর্টে ছটি ঘর। তখন ছিল তিনটে এসি, তিনটে নন-এসি। এখন অবশ্য সবকটিই এসি ঘর। সকাল থেকে রাতের সব খাবারই মেলে সেখানে। খেয়ে হাত চাটার মতো না-হলেও যথেষ্ট ভালো তার মান। অথচ জায়গাটা কলকাতা থেকে খুব দুরেও নয়। ধর্মতলা, হাওড়া, গড়িয়া কিংবা বারুইপুর থেকে দিঘা যাওয়ার বাসে কাঁথি নেমে পড়লেই হলো। সেখান থেকেই গাড়ি ভাড়া করে দশ কিলোমিটারের পথ। খরচও দিঘা বা মন্দারমনির তুলনায় কমই।


পরদিন জোয়ার এলো সকালে। সেটাই সমুদ্র স্নানের উপযুক্ত সময় সেখানে। না হলে বালুতট পেরিয়ে সমুদ্র অনেকটা দূরে। অনেকটা চাঁদিপুর, সাগর কিংবা বকখালির মতো। সকালে গরম গরম পুরি, সব্জি আর চা খেয়ে নামা হলো সমুদ্রে। ঘন্টা দুয়েক স্নানের পরেই ফের যেন পেটে আগুন জ্বলছে। দুপুরের আয়োজন ছিল ভেটকি মাছের কালিয়া। আর রাতে চিকেন-রুটি-স্যালাড। শেষ পাতে মিষ্টি অবশ্য থাকতো। এবার তাড়াতাড়ি শুয়ে পরার পালা। পরদিন সকালেই বাস ধরতে হবে যে। ফেরার পথে মনটা খারাপের থেকে খুশিই হলো বেশি। বুঝলাম, সম্পর্কগুলো ছিলো আসলে ‘পস’ বাটনেই। যেখানে থেমেছিলো আলোচনাটা যেন শুরু হলো সেখান থেকেই।

Share.

2 Comments

  1. Avishek Khan on

    চমৎকার লেখা, ও দেশের মাছ-ভাজার মতোই মুচমুচে। ঘরের কাছে এমন এক নিরালা ঠিকানার সন্ধান দেবার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।

Leave A Reply

Exit mobile version