সংগ্রামেশ তালুকদার। ছবি: প্রতিবেদক

ভ্রমণপিপাসু দুই বন্ধু হঠাৎই ঠিক করে ফেলি দুই দিনে চষে ফেলবো বীরভূম সংলগ্ন কয়েকটি জায়গা। সেটা নভেম্বরের শুরুর দিক। হাতে সময় ছিল কম, তাই অনেকগুলো জায়গা তালিকায় থাকলেও দুজনে বেছে নিই কেবল শান্তিনিকেতন ও ম্যাসানজোড়।
তবে আর চার-পাঁচটা ভ্রমণের থেকে আমাদেরটা ছিল একটু আলাদা। ট্রেন বাসের নরম গদিতে গা না ভাসিয়ে আমরা বেছে নিয়েছিলাম আমাদের দু’চাকার বাহন স্কুটিকে। বন্ধুবান্ধবদের অনেকেরই ভ্রূকুঞ্চিত হয়েছিলো স্কুটিতে যাওয়ার কথা শুনে। কিন্তু আমাদের ভরসা ছিলো এই দ্বিচক্রযানের ওপর এবং সে সেই ভরসার মর্যাদাও দিয়েছে যথাযথ। দ্বিচক্রযানের সাথে সাথে গুগুল ম্যাপও আমাদের যাত্রায় সারথীর ভূমিকা পালন করেছে।

কল্যাণী থেকে রওনা দিই লালমাটির দেশ বীরভূমের উদ্দেশ্যে। সকাল সাড়ে নটায় রওনা দিয়ে বোলপুর চৌরাস্তায় পৌঁছালাম বেলা দেড়টা নাগাদ। সূর্য তখন মধ্যগগন থেকে পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করেছে।

শান্তিনিকেতন আমাদের দুজনেরই অনেকবার দেখা। তাই শান্তিনিকেতনকে ডানদিকে ফেলে স্কুটির চাকা গড়িয়ে দিই বনের পুকুরের দিকে। বনের পুকুর বিখ্যাত তার শনিবারের হাটের জন্যে। আমাদের সৌভাগ্য রবিবারে গিয়েও হাটটি খোলা পেয়েছিলাম। গ্রামের মানুষেরা পসরা সাজিয়ে বিকিকিনিতে মত্ত। শান্তিনিকেতনের হাতের কাজ থেকে নানা ধরনের স্যুভেনির কি নেই সেখানে!এখান ওখান থেকে ভেসে আসছে বাউল গানের মন কেমন করা সুর। জায়গায় জায়গায় আদিবাসী মহিলারা আদিবাসী নৃত্যে মগ্ন। কোথাও কোথাও তাদের সাথে পা মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টায় শহুরে কয়েকজন।

ইতিমধ্যে পেটে ছুঁচোয় ডন বৈঠক শুরু করেছে। তাই ঢুঁ মারলাম ওই মনোরম পরিবেশে অবস্থিত শকুন্তলা রেস্টুরেন্টে। নামেই রেস্টুরেন্ট। ভাবতেই পারিনি ভিতরে আমাদের জন্যে কি চমক অপেক্ষা করছে। সাঁওতাল মেয়েরা মাটির হাঁড়িতে করে পদ্মপাতায় পরিবেশন করছে বাসমতি চালের ভাত, ডাল, শুক্তো ইত্যাদি। সাথে রয়েছে মাটির গ্লাসে জল। চারপাশ খোলা রেস্টুরেন্ট। সাজানো রয়েছে মাটির হাঁড়ি, ঝুড়ি, হ্যারিকেন এবং এরকম আরো নানা গ্রামীন সরঞ্জামে। মেনু হয়তো আহামরি নয়, কিন্তু এমন পরিবেশ গুনে গুনে দশ গোল দেবে শহরের পাঁচতারা রেস্তোরাঁ গুলোকে।

পেটপুজো করে আমরা বেশ কিছুটা সময় কাটালাম সংলগ্ন সোনাঝুরির জঙ্গলে।ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গলের মানুষ আমরা। এমন পরিবেশ পেয়ে শিকারি ক্যামেরা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ছবির অন্বেষণে। তোলা হল অগুনতি ছবি।
সম্বিৎ ফিরতে দেখলাম ঘড়ির কাঁটা বলছে সময় বিকেল চারটে। ঠিক করে ফেললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য- শক্তিপীঠ কঙ্কালীতলা। বনের পুকুর থেকে ১৫ কিমি। একান্ন পিঠের একটি পিঠ এই কঙ্কালীতলা। কথিত আছে এখানে দেবীর হাড় পড়েছিলো। বড় মনোরম সে জায়গা। দিনের পড়ে আসা আলো দেবীপীঠকে করে তুলছিল মোহময়। সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো। তাই বেশিক্ষন থাকতে পারিনি ওখানে। রওনা দিই জেলা সদর সিউড়ির উদেশ্যে।

আমরা কোনো হোটেলে রাত্রিবাস করতেই পারতাম। কিন্তু তাতে কেমন যেন টুরিস্ট টুরিস্ট অনুভূতি হতো। আমরাতো টুরিস্ট নই। আমরা ট্রাভেলার! রাত্রে তাই মাথা গুঁজেছিলাম আমার ভ্রমন সঙ্গীর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেই বাড়িটিও একটু গ্রামের দিকে। তাই সেই রাত্রিবাস আমাদের যাত্রায় যেন এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলো।

চলবে…

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version