সংগ্রামেশ তালুকদার। ছবি: প্রতিবেদক

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে রওনা দিই ম্যাসানজোড়-এর উদ্দেশ্যে।সিউড়ি থেকে মাত্র ৩৩ কিমি দূরে ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর অবস্থিত এই ম্যাসানজোড় ড্যাম।রয়েছে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও। ম্যাসানজোড় যাওয়ার রাস্তাটিও বড় মনোরম।রাস্তার দুদিকে অবস্থিত বালি খাদানে জমিয়ে রাখা বালি মনে করিয়ে দিচ্ছিল সোনার কেল্লাকে। প্রায় ৫৫ মিনিট যাত্রার পরে পৌঁছালাম গন্তব্যে।রাস্তার ধারের ছোট্ট দোকানে বাটার টোস্ট চিবাতে চিবাতে উপভোগ করছিলাম ড্যামের জলরাশি। খেয়ে দেয়ে ঘুরে দেখলাম ড্যাম সংলগ্ন এলাকা। একটি সুন্দর পার্কও রয়েছে। তবে পার্কটি কেবল ওই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত কর্মচারীদের জন্যেই।সাধারণ টুরিস্টদের জন্যে ম্যাসানজোড় এটুকুই। কিন্তু ওই যে! আমরা তো আর সাধারণ টুরিস্ট নই। তাই পেয়ে বসলো অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। আমরা তাই দুমকা সিউড়ি রোড ধরে দুমকার দিকে কিছুটা গেলাম। ভাগ্যিস গেলাম! কারণ সেখানেই পেলাম জল এবং পাহাড়ের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। সর্বোপরি জায়গাটি একবারেই জনশূন্য। কেবল আমি, আমার সঙ্গী আর সাথে পাহাড় ছুঁয়ে আসা বিপুল জলরাশি! মনে হচ্ছিল এই বিপুল জলরাশি কেবল আমাদের জন্যেই। সব অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। এটাও ঠিক তেমনই এক অনুভুতি। প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে কোথাও যেন ভুলে গেছিলাম দুপুরের খাবারের কথা। সোজা রাস্তায় এগিয়ে পেলাম ঝাড়খন্ড সরকারের এক পরিত্যক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই নির্জন জায়গায় ওরকম একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছিলো সেই সব দিনের কথা যখন স্কুলচত্বর গমগম করতো বাচ্চাদের কলতানে।

ঘড়িতে তখন বেলা দুটো। আমার ভ্রমন সঙ্গীর তখন মনে পড়লো তার শৈশবের গ্রাম রাজনগরের কথা। সে ছোটবেলায় বড়দের মুখে শুনেছিল রাজনগর থেকে নাকি ম্যাসানজোড় খুবই কাছে। একটা দুর্গম রাস্তা নাকি আছে। ওর কাছে কথাটা শুনে গুগল ম্যাপ সার্চ করতেই চোখ কপালে! রাস্তাটা গুগল ম্যাপেও রয়েছে! এবং দূরত্ব মাত্র ২৩ কিমি! অগত্যা দেরি না করে রওনা দিলাম রাজনগরের দিকে। সে এক অবর্ণনীয় রাস্তা। বিস্তীর্ণ রাস্তা কিন্তু আমরা ছাড়া আর কাউকে সেরকম চোখে পড়ছে না। টুরিস্ট তো দূর অস্ত, গ্রামের মানুষও বেশ কম। তার মধ্যেই দূরে দেখা যাচ্ছে ধান গাছ আর গম গাছের সারি। মাথা দুলিয়ে আহ্বান জানাচ্ছে এই আগন্তুকদের। মাঝে মাঝে কয়েকটি আদিবাসী গ্রাম চোখে পড়লো। তারা এমন ভাবে আমাদের দিকে দেখছিলো যে বোঝাই যাচ্ছিলো অনেকদিন বাইরের মানুষজনের পা পড়েনি সেখানে। সিসাল ফার্মকে ডান দিকে রেখে জয়পুর গাংমুড়ি হয়ে এগিয়ে চললাম রাজনগরের দিকে। পথে ভদ্রকালির মন্দির ছিল, কিন্তু সঙ্গীটির ভুলে সেটা আর এযাত্রায় দেখা হলো না। ও মন্দিরটির কথা বেমালুম ভুলে গেছিলো।

রাজনগরের পাঠান রাজার রাজবাড়িতে পা রাখলাম। ১৬০০ সালে তৈরি এই রাজবাড়িতে টুরিস্টদের তেমন পা পড়েনা। কিন্তু ওই হেমন্তের বিকেলে রাজবাড়ির দালানে দাঁড়িয়ে গা টা কেমন যেন শিরশির করে উঠছিলো।

পড়ন্ত বিকেলে ফিরে এলাম সিউড়িতে। মনে হচ্ছিল যেন আরও সময় হাতে থাকলে বেশ হতো! দুপুরের খাওয়াটা বিকেলে স্থানীয় এক রেস্টুরেন্টে কফির কাপে চুমুক দিয়ে পূরণ করলাম। যত সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো, মনের ভিতরটা তত যেন খালি হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল কাল থেকে আবার ফিরে যেতে হবে রোজকার ভাঙাগড়ার জীবনে।

রাতটা সঙ্গীটির আত্মীয়ের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন রওনা হলাম বোলপুরের উদ্দেশ্যে। আমার সঙ্গীটির তাড়া থাকায় সে ট্রেনে বাড়ি ফিরবে। বোলপুর স্টেশনে তাকে বিদায় জানালাম। মনে তখন যেন বিসর্জনের বাজনা বাজছে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এলাম কল্যাণী। শেষ হলো একটি মনে রাখার মত যাত্রা।

শেষ

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version