প্রথম পর্ব

চারশো বছর আগে শেক্সপিয়ার ‘উইন্টার টেল’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন। শেক্সপিয়রের এই নাটকটি ঠিক কবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তার নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। তবে নাটকটি ১৬২৩ সালে ফার্স্ট ফোলিও রচনাগুলির সংগ্রহে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি বেশিরভাগ সময়েই শেক্সপিয়রের হাস্যরসাত্মক রচনাগুলির সঙ্গেই প্রকাশিত হয়েছে, তবে অনেক আধুনিক সাহিত্য সমালোচক এটিকে একটি রোম্যান্টিক রচনা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। নোবেল প্রাপ্ত ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্ট যার কবিতা প্রকৃতির নিটোল, সরল চিত্র আর মানুষের জীবনের দিন-প্রতিদিনের ঘটনা আঁকলেও জীবনকে গভীরতর রহস্যের আবর্তে ফেলে দেয়। যিনি প্রথাগতভাবে প্রকৃতিকে না দেখে, চিরায়ত বিশ্বাসকে গ্রহণ না করে নিজস্ব আধুনিক একটি ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি ‘স্টপিং বাই উড্‌স অন আ স্নোয়ি ইভিনিং’ নামে একটি ছোট্ট কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটির শেষ চারটি লাইন The woods are lovely, dark and deep, /  But I have promises to keep,  / And miles to go before I sleep, / And miles to go before I sleep. স্মরণীয় হয়ে আছে।

ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, বিস্ময়কর সময়- শীতকাল। হিমশীতল, নিষ্ঠুর, কিন্তু যাদুকর। তিনিই আবার বলেছিলেন, হাস্যরস হল সূর্য যে মানুষের মুখ থেকে শীতকে সরিয়ে দেয়। ‘লা মিজারেবল’ ভিক্টর হুগোর আঁকা উনিশ শতকের ফ্রান্সের সকরুণ জীবনচিত্র।এই উপন্যাসের নায়ক জা ভালজা বিশ্বসাহিত্যের এক বিরল চরিত্র। ‘লা মিজারেবল’-এ শীতের এক বর্ননায় হুগো লিখেছেন, সেবার দক্ষিণ ফ্রান্সে খুবই শীত পড়লো। শীতের জন্য বাইরের কাজকর্ম থেমে গেল। কাঠ কেটে আর আগের মতো রোজগার হয় না। অন্য কোন কাজও মিলছে না। অবস্থা দিন-দিন কঠিন হয়ে উঠলো। পর-পর কয়েকদিন ভালজাঁ কোন কাজ পেল না। এক টুকরো রুটি জোগাড় করাও কঠিন অবস্থা। না খেতে পেয়ে বোনের ছোটোছোটো ছেলেমেয়ে নির্জীবের মতো পড়ে রয়েছে। দরোজায়-দরোজায় ভালজাঁ সাহয্যের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সবই নিস্ফল চেষ্টা। 

শীত নিয়ে আন্তন চেখভের বিখ্যাত উক্তি, “মানুষ সুখী হলে জানতে চায় না, এটি শীত না বসন্ত”। শীতের মাঝে,  আমি আমার মধ্যে একটি অদম্য গ্রীষ্ম খুঁজে পাই। এই উক্তিটি আলবেয়ার কামুর। কবি শেলির কথা “ওঃ ইফ উইন্টার কাম্‌স, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড” তো আমরা সবাই জানি। জাপানি কবি বাশো তার হাইকুতে পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “অষ্টদৃশ্য বেশ/সাতটি কুয়াশায় ঢাকা/একটির ঘণ্টা ঢং ঢং।” তিনি হয়তো এমনটাই বলতে চেয়েছেন যে আমাদের চার পাশের যাবতীয় বিষয়, সৌন্দর্যের, ভালো লাগার, বেশির ভাগই শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন। সে সবের দেখা পেতে গেলে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে; অন্তত কুয়াশা সরে যাওয়া সূর্যালোকের সকাল পর্যন্ত। আলেকজান্ডার পুশকিন ‘A Winter Evening’ কবিতায় লিখছেন, Sable clouds by tempest driven,/ Snowflakes whirling in the gales,/ Hark–it sounds like grim wolves howling,/ Hark–now like a child it wails!

ইমোজেন রবার্টসন তাঁর ‘দ্য প্যারিস উইন্টার’ উপন্যাসে প্যারিসের বিশ শতকের  ইতিহাস বর্ণনা যেমন করেছেন, তাঁর আখ্যানে তিনি নায়িকার একাকিত্বও তুলে ধরেছেন। ইলানা তান-এর সাড়া জাগানো কাহিনি ‘উইন্টার ইন টোকিও’-তে শীতের একটা দারুণ পরিবেশন পাই। জ্যান টারল্যু-র ‘উইন্টার ইন ওয়ারটাইম’ আদতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাকে আশ্রয় করে লেখা। তবে জার্মান বাহিনীর হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হল্যান্ডবাসীর শীত ও খিদের যন্ত্রণাও ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। বেস্টসেলার সি জে স্যানসম-এর ‘উইন্টার ইন মাদ্রিদ’ আখ্যানটির প্রেক্ষাপটও ১৯৪০ সালে স্প্যানিশ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউরোপে ফরাসি সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কথা। শীতের প্রেক্ষিতে এক যুবক এবং এক অন্ধ যুবতীর ভালোবাসা ক্রমশ আস্থা হারাতে থাকে ‘দ্যাট উইউন্টার দ্য উইউন্ড ব্লোজ’ নামক কোরিয়ার জনপ্রিয় নাটকে। অন্য দিকে শীতকে বিদায় জানানোর কথা বলেছেন ‘ডেড অব উইন্টার’ নামক ছোটোগল্পে অস্ট্রেলিয়ান লেখক স্টিফেন ডিডম্যান। আর নতুন কোনো শীতকে আহ্বান জানিয়েছেন রেবেকা কে ওকোনর তাঁর ‘ওয়ান মোর উইন্টার’ গল্পে।

শীতের রাতের শব্দ ছিল মেলানকোলি-একথা বলেছিলেন যিনি সেই ভার্জিনিয়া উলফ কিন্তু এক শরতে বাতাসে হালকা শীতের আমেজ, শীত যাই যাই করছে, তাঁর মনে ভিড় করেছে কত কথা, বিষণ্ণতার ঢেউ উঠেছে, কেউ রাখেনি তার মনের খবর, পকেটে পাথর ভরতি করে চলে গেলেন নদীর ধারে, যে নদীর ধার ঘেঁষে চলে যাওয়া যায় এক না-ফেরার দেশে- সেখানে হয়তাও কোনো মন খারাপই আর ছুঁতে পারে না কাউকে! ‘তোমারই প্রান্তরে বিছিয়ে থাকা, আবহমান ঋতু বৈচিত্র্যকে যেমন তুমি মেনেছ,   তেমনই হৃদয় জুড়ে ঋতুর এই খেলাটিকেও তুমি মানতে পারবে। শীতের হাহাকারের মধ্যেও, দুঃখকে তখন তুমি দেখবে এক গভীর প্রসন্নতায়’। এমন সংলাপ পাই খলিল জিব্রানের ‘দ্য প্রফেট’-এ। শীতের একটি আশ্চর্য ঘটনার কথা বলেন হারুকি মুরাকামির ছোটোগল্প গ্রন্থ ‘দ্য এলিফ্যান্ট ভ্যানিশেষ’-এর একটি গল্পে- এক শীতে ছেলেটির আর মেয়েটির ভয়ানক ইনফ্লুয়েঞ্জা হল কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁরা জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দুলতে দুলতে তাদের জীবনের সব স্মৃতি হারিয়ে ফেললো। যখন তাঁরা সেরে উঠলো তখন তাঁদের মাথা শিশু ডি এইচ লরেন্সের পয়সা জমানোর মাটির ব্যাঙ্কের মতো ফাঁকা হয়ে গেল।

Share.

2 Comments

  1. sudipta sanyal on

    দারুন নির্বাচন ভালো লেখা। আমার সকালের বিষণ্ণতা কেটে গেল যে লেখায়। আমিও বোধকরি এক শীতেই হারিয়ে যাবার অন্তিম পরিকল্পনা ফেঁদে রাখবো

Leave A Reply

Exit mobile version