পঞ্চম পর্ব

ধরা পড়ার পর বিচারে আল কাপোনের পরবর্তী গন্তব্য হয় আটলান্টার কারাগারে।কথায় বলে দুরাত্মা আর দুর্নীতি পাশাপাশি চলে। কথাটি আলফোনসো কাপোন ওরফে বিগ আলের জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আটলান্টার জেলেই হয়ত কাপোনকে পচে গলে মরতে হত। কিন্তু কারাভোগের বয়স দু’বছর পেরতে না পেরতেই কাপোন এক জেলরক্ষীকে ঘুষ দিতে গিয়ে ধরা পড়লেনন। জেলে ঘুষকাণ্ডে  ধরা পড়তেই কাপোন নিজের জন্য আরও বড় সর্বনাশ ডেকে আনলেন। এই ঘটনার পরই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আলকাত্রাজের উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত দ্বীপ কারাগারে। আলকাত্রাজে যাওয়ার পর আল কাপোনের নাম অপরাধ দুনিয়া থেকে প্রায় হারিয়েই যান। আর তাঁর নাম শোনা যেত না। ততদিনে শিকাগোর অপরাধ জগতে নতুন ডন মাফিয়ার আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে। ফলে আল কাপোনের প্রতিপত্তি আর টিকে রইলো না।

আটলান্টার জেলে থাকাকালীন দিনে দিনে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে থাকে। অনেক বছর আগে তিনি একবার  সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই পুরোনো রোগ ফের নিউরোসিফিলিসের রূপ ধরে তাঁর শরীরে আবার ফিরে আসে। এক কালেরে মাফিয়া বস শারীরিক এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাকে জরুরি ভিত্তিতে মাত্র সাড়ে ছ’বছর পর জেল থেকে মুক্তি দিয়ে বাল্টিমোরের এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু তাতেও তাঁর স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। তিন বছর চিকিৎসার পর তাঁর শারিরীক কোনও উন্নতি হয়নি দেখে তাঁকে মায়ামিতে তাঁর স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জীবনের এই শেষ সময়টুকু তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছেই ছিলেন। এর পরেও দুনিয়া কাঁপানো মাফিয়া ডনের হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে পাবলিক এনিমি নাম্বার কাপোনের মৃত্যু হয়।

আল কাপোনের মৃত্যুর পর বড় বড় পত্রিকায় খবর ও ফিচার প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক টাইমসের শিরোনামে লেখা হলো, “এক দুঃস্বপ্নের অবসান”। এই জীবন বৃত্তান্তের বাইরেও আল কাপোনকে নিয়ে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে যা জানতে পারলে তার সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা আরেকটু পরিষ্কার হবে। আল কাপোনের বুলেট প্রুফ গাড়ি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ব্যবহার করেছিলেন। কাপোন তাঁর পরিকল্পনায় নিহত হওয়া মানুষদের শেষকৃত্যে নিহতদের পরিবারের কাছে দামি ফুল এবং উপহার সামগ্রী পাঠাতেন। এই রীতিটি বহুকাল পর্যন্ত আল কাপোনের স্বাক্ষরের মতো কাজ করতো। আল কাপোনের পোশাক-পরিচ্ছদের প্রশংসা করেছিলেন বিখ্যাত লেখক ডেল কার্নেগি। তার মতে, সফল ব্যবসায়ীদের পোশাক এমনটাই হওয়া উচিত। আল কাপোনকে আলকাত্রাজে পাঠানোর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল নতুন উদ্বোধন হওয়া কারাগারের বিজ্ঞাপন হিসেবে তুলে ধরা। সেই কারাগারে আল কাপোন একটি রক ব্যাণ্ডের হয়ে বাঞ্জো এবং গিটার বাজাতেন।

নিষিদ্ধ হলেও শিকাগোর সবাই মদ পান করতে পছন্দ করতেন। এজন্য মদ পছন্দ করা বিচারপতিরা তাকে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহানুভূতি দেখাতো বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ১৯৩৩ সালে যখন অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়ের উপর থেকে যখন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল, তখন অনেকেই আল কাপোনের উপর সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। ‘দ্য আনটাচেবলস’ সিনেমায় আল কাপোনের চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো। তবে সিনেমায় বর্ণিত এলিয়ট নেসের ভূমিকা অনেকটাই অতিরঞ্জিত ছিল। আল কাপোনের অপরাধ জগতকে সবাই ঘৃণা করতো এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে যাই হোক না কেন, আল কাপোনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো সহানুভূতি হতে পারে। বরং তাঁর প্রতি ঘৃণা আর বিদ্বেষই প্রত্যাশিত। যে কারণে এখন পর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাসে আল কাপোন সবচেয়ে কুখ্যাত মাফিয়া বস হিসেবে পরিচিত হয়ে রয়েছেন।

আল কাপোনের খ্যাতি  বলা ভাল কুখ্যাতি এই যে তিনি বিশ্বের ভয়ঙ্করতম গ্যাংস্টারদের অন্যতম। তবে তিনি ছিলেন ধনকুবের। স্রেফ তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা না করায় তিনি একসঙ্গে শতাধিক মানুষকে খুন করেছেন। আবার কোটি ডলারের সম্পত্তির প্রতিটি পাই আনা বিলাসিতা, উপভোগ, সম্ভোগে ব্যয় করেছিলেন- ভাল সিগার, ঝকঝকে স্যুট, কেতাদুরস্ত খাবার দাবার আর  নারীসঙ্গ করে। কাপোন ভাল থাকার কোনও উপায়কেই ব্রাত্য করে রাখেননি। বিলাসপ্রেমী কাপোন একটি প্রাসাদোপম বাড়িও কিনেছিলেন ফ্লোরিডার সাজানো সৈকত মায়ামিতে।  সেই বাড়িও সম্প্রতি ১ কোটি ১৪ লক্ষ পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে। তবে জীবনের শেষ ১১টা বছর তাঁকে কাটাতে হয় দ্বীপান্তরে। এক কামরার ছোট্ট একটা সেলে। যেখানে ঘুমনোর জায়গার পাশেই ছিল শৌচের স্থান। পেট ভরানোর জন্য ছিল শুধুই জেলের খাবার।

শেষ

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version