পঞ্চাশ হোক কিম্বা পচাত্তর; স্বাধীনতা দিবস মানেই সরকারি ছুটি, সাত সকালে প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, মাইকে এলাকা কাঁপিয়ে দেশাত্মবোধক গান বাজানো, একদিনের ফুটবল টুর্নামেন্ট, রক্তদান শিবির, পাড়ার ক্লাবের পিকনিক, বন্ধুরা মিলে মদ্যপান, ফেসবুকের নিজের প্রোফাইল জাতীয় পতাকার তিনরঙে মুড়ে দেওয়া... স্বাধীনতার জন্য কত শত জীবন বলিদান, ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচার সহ্য করা। এক দিনে মেলেনি স্বাধীনতা, অনেক রক্ত ঝড়িয়ে, লাগাতার সংগ্রাম করে কেড়ে নিতে হয়েছে। আজ তো উদযাপনের জোয়ারে ভেসে যাওয়ারই কথা। আগের রাতেই লম্বা লাইন পরেছিল মাংসের আর মদের দোকানে, ব্যস্ততা ছিল জাতীয় পতাকা কিনতে।

স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন বাজী রেখে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন ভারত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা পেলে সাধারণ দেশবাসীর মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ হবে, মানুষের বেঁচে থাকার রোটি-কাপড়া-মকান ছাড়াও শিক্ষা স্বাস্থ্য সুস্থ পরিবেশ, উপযুক্ত সৃষ্টি ও সংস্কৃতির মতো ন্যূনতম চাহিদাও মিটবে। কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই ফুটে উঠল এক অন্য ছবি। স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল একটা ভারতের মধ্যে আরও কয়েকটা ভারত। একদিকেমুষ্টিমেয় কিছু মানুষ প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন, অন্যদিকে কিছু মানুষ পড়ে রয়েছে যেখানে রোদ্দুর নেই, বাতাস নেই, উত্তাপ নেই।  আছে কেবল খিদে আর খিদে কিন্তু পেট ভরানোর খাবার নেই। এই নেই আর নেই রাজ্যে পড়ে আছেন অনেক অনেক মানুষ। তবে তো এটাই বলতে হয় যে আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন করছি অথচ অধিকাংশ মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকে গেল। তাহলে স্বাধীনতা মানে কী ফুঃ …

অন্যদিকে পচাত্তর, আশি, একশো বছর আগে মহাত্মাজি, মৌলানাজি, প্যাটেলজি,  নেহেরুজি প্রমুখ ভারত মাতার বীর সন্তানেরা দেশাত্মবোধে উদিপ্ত হয়ে যে জাতীয় আন্দোলন শুরু করেছিলেন তারা কি একবারও এটা ভেবেছিলেন যে খণ্ড খণ্ড করা ভারতের স্বাধীনতাকেই তাঁদের গ্রহণ করতে হবে সে ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছায়। যদিও এক অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা লাভের আশা নিয়েই তাঁরা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। কিন্তু যে স্বাধীনতা মিললো তা কি ব্রিটিশদের থেকে পাওয়া নাকি অর্জণ। ইতিহাস অন্তত বলে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র প্রথম থেকেই আপসহীন নিরবচ্ছিন্ন চূড়ান্ত সংগ্রাম জারি রাখার কথা বলেছিলেন। ১৯৩৮-এর হরিপরা কংগ্রেসেও তিনি বলেছিলেন, বৈঠকী রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিলে ব্রিটিশ সরকার কিন্তু দেশকে ভাগ করে দিয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন তাঁর কথা কেউ কানেই তোলেননি। তাঁর কথা কানে নেওয়া তো দূরের কথা, পর পর দু’বার কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেও গাঁধীজির সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত, কংগ্রেসের বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করার জন্য তাঁকে কংগ্রেস দল থেকে পদত্যাগও করতে হয়।

একটা সময় তো কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের সম্পর্ক চূড়ান্ত অবনতির পথে এগিয়ে যায়। ঠিক সেই সময়েই লর্ড মাউন্ট ব্যাটন ভারতের মাটিতে পা রাখেন।ওই সময় কংগ্রেস নেতারা নিজেরাই যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্থ। লিগ নেতা জিন্না দাবি করে যাচ্ছেন পৃথক ইসলামী রাষ্ট্রের। মাউন্টব্যাটন কংগ্রেস নেতাদের দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতাকে সঠিক সময় কাজে লাগিয়ে ছিলেন। প্যাটেল, গাঁধীজি, নেহেরু সবাইকেই সুযোগ মতো কায়দা করে পথে নিয়ে আসেন। জিন্নার দাবি মতো ভারত ভাগের ব্যবস্থাও চূড়ান্ত হয়ে যায়। না হয়ে তখন আর উপায় কই। সর্দার বল্লভভাই যুক্তি দিলেন, পাকিস্তানকে ঠেকাতে গেলে গোটা দেশটাই পাকিস্তান হয়ে যাবে। সর্দারের সুরে সুর মিলিয়ে নেহেরু বললেন, দেশভাগ মেনে না নিলে আবার আন্দোলন করতে হবে, আবার জেলে যেতে হবে। আর সেই চূড়ান্ত বৈঠকের দিন ছিল গান্ধীজির মৌনব্রত দিবস। ইতিহাস একথাও জানায়, কংগ্রেস ১৯৩৭ সালের নির্বাচন জিতে মন্ত্রিসভা গঠন করেছে।স্বভাবতই প্রশ্ন এসে পড়ে, কোন ক্ষমতার লোভে কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা গঠন?তাহলে মুসলিম লিগের দ্বি-জাতি তত্ত্ব কেন শুধু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বলে আখ্যায়িত হবে। তার মানে পাকিস্তানের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলে এসেছে।কেবল তাই নয়, স্বাধীনতা লাভের অন্তত দশ বছর আগে থেকেই ভারতীয় রাজনীতি খুব দ্রুত গতিতেই দেশভাগের দিকেএগিয়ে যাচ্ছিল।

তাই পচাত্তর বছরে পৌঁছেও বলতে হয়, তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা দেশ ভাগ মানতে হল মাথা পেতে। তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা১০ লক্ষ মানুষকে মরতে হয়েছিল,আরো কয়েক লক্ষ মানুষ নিজের জন্মস্থানছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল৷ তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা নানা মত ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের উপমহাদেশকে ভাগ করে ধর্মের ভিত্তিতে, অবিশ্বাস ও অনৈক্যের যুক্তি দিয়ে জোর করে জন্ম দেওয়া হয়েছিল একটি দেশ– পাকিস্তান৷সেই জন্মযন্ত্রণা, দাঙ্গা এবং শারীর ও মনের কষ্ট কখনও লাঘব হয়নি৷ ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে সেই দুটি রাষ্ট্র- ভারত ও পাকিস্তান, কিন্তু ঘা রয়ে গেছে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যরাতের মতোই দগদগে৷

তবু এই স্বাধীনতা দিবসে আমরা নিশ্চয় তাদের বক্তৃতা শুনবো যারা ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন করাকে জাতীয়তাবাদ বলে মনে করেননি। আমরা তাঁদের বক্তৃতাও শুনবো যারা হাজার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা আমরা নিশ্চয়...
Share.

2 Comments

  1. indranil tarafdar on

    যারা ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন করাকে জাতীয়তাবাদ বলে মনে করেননি, তারাও স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে, যারা কোটি কোটি টাকা চুরি করে, ঘুষ খায় তারাও স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে, তাহলে স্বাধীনতা আনে কী?

  2. subimal dhar choudhury on

    স্বাধীনতার ৭৫ বছর যতই ধূমধাম করে পালিত হোক না কেন, দেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার চার আনাও পূরন হয়নি। যে অন্ধকারে তারা পড়েছিল সেখান থেকে এক ধাপ উপরে তারা উঠে আসেনি। তাহলে এই স্বাধীনতা দিয়ে সাধারণ মানুষ কি করবে? দেশের সর্ব ক্ষেত্রে উপর থেকে নীচে দুর্নীতি, মুষ্টিমেয় মানুষের রাজ চলছে। স্বাধীনতা কথার একটাই অর্থ দুর্নীতিরাজ।

Leave A Reply

Exit mobile version