ভারতের সঙ্গে আরব দেশগুলির সম্পর্ক যে সবসময় ভাল ছিল তেমনটা নয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের সময় আরব দেশগুলি পাকিস্তানকে সমর্থন জানিয়েছিল। পরবর্তীতে কাশ্মীর ইস্যুতেও তারা পাকিস্তানের পাশে থাকায় আরব দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ কিছুকাল ধরে ঠান্ডা মেরে ছিল। ২০০২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সময় আরব লীগের সঙ্গে নতুন করে ভারতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এর আগে দুই পক্ষের সম্পর্ক মূলত উপসাগরীয় দেশগুলি থেকে জ্বালানি তেল আমদানি এবং আরব দেশগুলিতে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় অভিবাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

তবে গত দু’দশকে উপসাগরীয় এবং আরব রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ, সেটি অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির কারণে। উল্লেখ্য,উপসাগরীয় দেশগুলির জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের সদস্য ৬টি দেশ থেকেই ভারতের মোট আমদানির অর্ধেক আসে।ইরান এবং ইরাককে ধরলে যোগ করলে ভারতের পেট্রলের ৮০ শতাংশ আসে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে। সারা বছর ভারত যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে তার অর্ধেক আসে কাতার থেকে। বোঝাই যাচ্ছে যে ভারতের সঙ্গে এই সব দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কতখানি জোরালো।

অন্যদিকে ভারত বছরে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি করেইউএই’তে। অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ভারতের অর্থনীতি উপসাগরীয় দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল।এর মধ্যে জ্বালানি, তেল ও গ্যাস এবং রেমিটেন্স অন্যতম। ৮৫ লাখের বেশি ভারতীয় কাজ করে জিসিসির সদস্য উপসাগরীয় ছটি দেশে। তাছাড়া বহু ভারতীয় কাজ করেনঅন্য সব আরব দেশে। হিসাব অনুযায়ী আরব দেশগুলি থেকে প্রবাসী ভারতীয়রা বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠান।; ঠিক এ ধরণের একটি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের বিজেপির মুখপাত্রদের ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য মুসলিম বিশ্বের দিক থেকে ভারতকে খুবই চাপে ফেলেছে।প্রথমেই মুখ খোলে কাতার, কুয়েত ও ইরান। এরপর একে একেসৌদি আরব, ওমান এবং গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল(জিসিসি) ও অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন(ওআইসি) কথা বলা শুরু করে।ভারত বিরোধী বিক্ষোভে গলা মেলায় উপসাগরীয় এলাকায় ভারতের বিশেষ মিত্র হিসেবে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ বাহরাইন এবং ইন্দোনেশিয়াও।উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গেদেশের মিত্রতার জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগত কৃতিত্ব দাবি করলেও সেই উপসাগরীয় অঞ্চল গত কয়েক দিন ধরে দিল্লির ওপর ভয়ঙ্কর চটে আছে।

তবে বিজেপির মুসলিমবিরোধীতার কারণে পশ্চিম এশিয়ায় অস্থিরতা তৈরির ঘটনা যে এই প্রথমনয়। ২০২০ সালে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার জন্য মোদি সরকার দিল্লির তাবলিগ জামাতকে খোলাখুলি দায়ী করায় ভারতে ইসলাম–বিদ্বেষের ফুলকি ছড়িয়েছিল। সেই সময় দুবাইয়ের প্রবাসী ভারতীয় সৌরভ উপাধ্যায় তাবলিগ বিরোধী একটি টুইট নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে ট্যাগ করে আবুধাবির শাসক রাজ পরিবারের সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শেখ হিন্দ বিনতে ফয়সাল আল কাসেমিকে টুইট করেছিলেন। এর আগে ২০১৮ সালেও, তিনি রেস্তোরাঁর একজন ভারতীয় শেফকে ইসলামবিরোধী টুইট পোস্ট করেছিলেন।কিছুদিন আগে কাশ্মীর ফাইলস ছবিটি ছবিটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সম্প্রতি অক্ষয় কুমার অভিনীত নতুন ছবি পৃথ্বীরাজ ওমান ও কুয়েত নিষিদ্ধ করেছে। যদিও মোদি সরকার বিজেপির ওই দুই মুখপাত্রকে বরখাস্ত করেছে কিন্তু মহানবী(সা.) ও তাঁর স্ত্রীর বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য ভারতীয়দের কর্মসংস্থানের ওপর পড়বে বলে মনে হচ্ছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো ঘটনার পরওভারতকে একটি গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী এবং সহনশীল জাতির রোল মডেল হিসেবে দেখা হয় কিন্তু এই ঘটনা সেই ভাবমূর্তির ওপর মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে(২০১৪ সালের আগে ও পরে)এই—উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে দিল্লির যে সম্পর্ক, তার সঙ্গে ধর্মের খুব একটা সম্পর্ক নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের ধর্ম কেন্দ্রিক নানা বিতর্ক ওই সম্পর্কের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছে।

যদিও এক দল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত, উপসাগরীয় এবং আরব রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মূল ভিত্তিটি হল মূলত অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগনির্ভর। ভারতের কাছে এই সব দেশের তেল বিক্রি হয় এবং এই সব দেশে ভারতের বিশাল কর্মিবাহিনীর অবস্থান রয়েছে। অতএব ধর্মীয় অনুষঙ্গ খুব একটা বড় ভূমিকা নিতে পারবে না।সেই কারণে মুসলিম দেশগুলির এই ক্ষোভের মধ্যেও দিল্লির আশা, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ভারতের গোয়েন্দাদের সাহায্য নিয়ে আইএস–সংশ্লিষ্ট কয়েক ডজন লোককে উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে পাকড়াও করেছিলএবং তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেছিল। এছাড়াও ভারতসংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ওমানের মতো উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়ে থাকে। উল্লেখ্য গত মার্চ মাসে ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট নামে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যেটিকে জিসিসি দেশগুলির সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির যাত্রা শুরুহিসাবে দেখা হয়।

অন্য এক দল বিশেষজ্ঞদের মত, বিষয়টাকে সহজ করে দেখার তেমন কারন নেই, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে। মুসলমানদের খাদ্য এবং পোশাক শৈলী থেকে শুরু করে আন্ত-ধর্মীয় বিবাহ প্রায়সই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনমুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মোদি সরকার ও বিজেপিকে অভিযুক্ত করেছে। তাদের বক্তব্য, মোদি সরকার তথা বিজেপি সংখ্যালঘু ২০.৪ কোটি মুসলমানদের প্রবল চাপে রেখেছে, যদিও ভারত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তর দেশ। তাছাড়া বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর, বিশেষ করে মুসলমানদের ওপর একাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। গরু রক্ষার নামে বেশ কয়েকজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সেসব ঘটনায় উপসাগরীয় দেশগুলির তরফে প্রকাশ্যে কোন বক্তব্য বা নিন্দা জানানো হয়নি। কিন্তু এবারের ঘটনাটি ব্যতিক্রম, কারণ ধর্মীয় বিষয়টিই প্রধান বিবেচ্য। সেই কারণে মুসলমান প্রতিবেশীরাও ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ তাই ভবিষ্যতে সতর্ক হতেই হবে।
Share.

3 Comments

  1. sunita chakrabarty on

    অতীতে ভারতে যেসব সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এবং হিংসার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ভারতের ঘরোয়া রাজনীতির অংশ হিসাবে দেখা হয়েছে। কিন্তু যখন মহানবী (সা.) ও তাঁর স্ত্রীর বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে তখন সেটা স্পষ্টতই একটি লাল রেখা অতিক্রম করা।

  2. Tapas bhattacharya on

    ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে ৫ জুন ২০২২ কাতার সরকার ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপির দু’জন নেতার ইসলামের শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির কড়া প্রতিবাদ হাতে ধরিয়ে দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘কাতার ভারত সরকারের কাছ থেকে এই মন্তব্যগুলোর জন্য জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার এবং অবিলম্বে নিন্দা প্রত্যাশা করছে।

  3. অমরনাথ মন্ডল on

    … চিরদিন, কাহার ও সমান নাহি যায় … আজকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায় … ?

Leave A Reply

Exit mobile version