মেঘ জড়ানো ফাগুন সকালে, বুকের মধ্যে জমে থাকা শেওলার পাহাড় ডিঙিয়ে কুলকুল করে কি যেন বয়ে যায়। তিরতিরে পাতার ফাঁক দিয়ে সহসা ডেকে ওঠে উদাস কোকিল। নিস্তরঙ্গ রক্তস্রোতে হঠাৎ যেন উত্তাল তরঙ্গের আলোড়ন। আকন্দের ঠোঁট বেয়ে চুঁয়ে পড়ে আকণ্ঠ চুমুকের আবেদন। মৌটুসির গাল বেয়ে চলকে পড়ে অতলান্তিক শিহরণ। রাতজাগা পাখির ডানার ওম জড়ো হয়ে ঘিরে ফেলে মেঘলা শরীর। ধোঁয়া ধোঁয়া চোখের পাতায় এসে জমাট বাঁধে ভেসে যাওয়া সব মাঠঘাট, আর কবেকার সেই মায়াবী সকাল।

বসন্ত এসে গেছে। টের পাই রুদ্রপলাশের বিস্ফারিত চোখে, শিমূলের তৃষিত ঠোঁটে, অস্থির কোকিলের মুহুর্মুহু আর্তিতে। বসন্ত এলেই কালের কাছে গচ্ছিত রাখা থোকা থোকা বাসন্তী ভোর কুয়াশার ফাঁক গলে ঝুপ করে নেমে আসে। লুটোপুটি খায় ঝুড়ি ঝুড়ি ঝরা পাতার পরিত্যক্ত হৃদপ্রাঙ্গণে। টলটলে দিঘীর উন্মনা ঢেউ ছুঁয়ে উড়ে যায় উতলা দখিণা বাতাস।

বসন্ত এলে, প্রাণের ভাষা জগৎসংসারের ভৌগলিক সীমানা ভাসায়। বসন্ত এলে, বঙ্গদেশের আবালবৃদ্ধবনিতার জীবনের ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের পুনর্নবীকরণ হয়। কোন এক উড়ুউড়ু কাঁচা বয়সে যে অনির্বচনীয় শব্দমালার আকুতি জড়িয়ে ছুঁয়ে ফেলেছিলাম কাঁপা কাঁপা আঙুলের বিশ্বাস, সেই অনির্বচনীয় শব্দমালার অবিকল অনুভূতি বাসন্তী আকাশ বেয়ে ঝুপ করে নেমে আসে। বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা জমাট রক্তক্ষরণ ছিন্নভিন্ন করে লুটোপুটি খায় শিরায়, উপশিরায় … আহ্ললাদে, আবেগে, প্রলাপে।

কেউ একদিন, এমনই কোন এক মন কেমনের বসন্তে, দুহাত ভরে উতলা ফাগুন চেয়েছিল। হিমশীতল হৃদয়ে জড়িয়ে নিতে চেয়েছিল রক্তপলাশের গনগণে উত্তাপ। শনশন দখিণা বাতাসের চোখের পাতায় ঠায় আটকে ছিল ভালোবাসার উত্তাল সমুদ্র। অপেক্ষার অস্থির পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দুর্দমনীয় জলপ্রপাত। ঠিক যেমন, নিদাঘ দুপুরে আকাশ কালো করে কালবৈশাখী ধেয়ে আসে। ঠিক যেমন, বৃষ্টি মুখর রাতগভীরে, পালকে পালক লাগার পুলকে অগ্নুৎপাত আছড়ে পড়ে। ঠিক সেই ক্ষণে, উদ্ভ্রান্ত চখাচখির ঠোঁট বেয়ে গলে পড়েছিল দুর্মর ভালোবাসার লয়হীন দাগ।

তার পর! বহুকাল হয়ে গেল রে। চিবুকের বলিরেখা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে চলেছে। শরীরের আনাচে কানাচে জমে থাকা মেঘমালা, সেই কবে বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেছে। বাকলে নেমেছে প্রৌঢ়ত্বের ভাঁজ। কাঁচাপাকা চুলের ফাঁক দিয়ে বয়ে গেছে অন্তহীন বেহিসেবি সময়। চেনা চেনা কবিতার পাঁজরের শেওলায় এখনও মিশে আছে কবেকার সেই স্মৃতিকাতরতা! তবু, তামাটে হৃদয়ের দুকূল উজাড় করে অনর্গল বয়ে চলে আজন্মের নীরবতা। তিরতিরে বাঁশপাতার দীর্ঘশ্বাস উড়ে আসে কুয়াশা জড়ানো আঙুলের আশ্বাসে। কাঁপা কাঁপা হাত। বৃষ্টি হঠাৎ। আনমনে ছুঁয়ে ফেলা।

এই উড়ুউড়ু বসন্তে, মন কেমনের আবেগের উচ্ছ্বাসে, অনাদিকাল ধরে না-বলা অন্তঃসলিলা শব্দমালা পরিত্যক্ত টিনের বাক্স গলে বাহির পানে ছুটে আসে। যেন, অন্তঃসলিলা সেই না-বলা অমোঘ শব্দমালার অনন্ত মুক্তির ঠিকানা আদুরী বসন্তের উদ্বেলিত শ্বাসেপ্রশ্বাসেই লেখা আছে …… আজও আমার সঙ্গে থাকে ফুল, পাখি আর উতল আকাশ। তুই যদি চাস ফাগুন আবার, আনতে যাবো রক্তপলাশ …

লেখক অধ্যাপক, সমাজ, রাজনীতি ও পরিবেশ বিশ্লেষক

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version