যদি অভিনেতা না হতেন, তা হলে নাকি ছুতোর মিস্ত্রি হওয়ার একান্ত ইচ্ছে ছিল তাঁর। এই উত্তর যে কেবল রসিকতা করে দেওয়া নয়, রীতিমতো সিরিয়াস সে তথ্য মেলে অর্জুন সেনগুপ্ত ও পার্থ মুখোপাধ্যায়ের  ‘সৌমিত্র চ্যাটার্জি: আ লাইফ ইন সিনেমা, থিয়েটার, পোয়েট্রি অ্যান্ড পেন্টিং’ গ্রন্থে।

তিনি কি নিছক এক জন অভিনেতা? মঞ্চ আর ক্যামেরার বাইরে তাঁর পরিচিতি লম্বা ছায়া ফেলে কবিতার পাতায়, ছবি আঁকার ক্যানভাসে, পত্রিকার সম্পাদনায়। এক দিকে শিশির ভাদুড়ি আর অন্য দিকে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গ করা এক বিরল মানুষ, যিনি একই সঙ্গে বহু গুণের অধিকারী।

কবি সৌমিত্রের জগৎটা ছিল একেবারেই আলাদা। বাংলা কবিতার পরম্পরায় তাঁর কবিতাগুলি নীরব অথচ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলেই মনে করেন কাব্যরসিকরা। কবিতার পাশাপাশি ক্যানভাসেও তিনি দক্ষতার পরিচয় রেখে গিয়েছেন। তাঁর আঁকা ছবির জগৎকে তাঁরই এক বন্ধু কবির শব্দবন্ধ ধার করে নিয়ে বলতে হয়, ‘সুন্দর, রহস্যময়’।

বলিউডের হাতছানি তাঁকে একটুও প্রলুব্ধ করেনি। অথচ সারা জীবন বাংলায় কাজ করা মানুষটি হয়ে গিয়েছেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের নক্ষত্র। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ১৪টি ছবি ছাড়াও তপন সিংহ বা তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকের ক্যামেরাতেও তিনি অন্য ঝলক দেখিয়ে গিয়েছেন। বাংলা সিনেমা, নাটক, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর বিপুল অবদান।

অনেক ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের দুই আলোচিত নায়ক উত্তম কুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একসঙ্গে তাঁদের পর্দায় দেখা যাক বা না যাক বাঙালি সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে চরম বিভক্তি ছিল তাদের প্রিয় নায়ক কে তা নিয়ে। বাংলার সিনেমাভক্তদের একদল মনে করতেন ‘জনতার মহানায়ক’ একজনই – তিনি উত্তম কুমার। আর প্রতিপক্ষ দলের পরিষ্কার রায় ছিল বুদ্ধিজীবী মননের চলচ্চিত্রে ‘শেষ কথা’ একজনই – তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

সিনেমা দুনিয়ার মানুষ হওয়া স্বত্বেও তিনি অন্য বাঙালি ছিলেন। তার পিছনে রয়েছে তাঁর বৌদ্ধিক অভিযাত্রা, পঠন-পাঠন, নিজস্ব সৃষ্টিজগৎ আর সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় সাবলীল বিচরণের ক্ষমতা। একইভাবে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনাতেও তাঁর নিজের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। ধর্মের নামে গোঁড়ামি আর বিভাজনের রাজনীতির তে তাঁর সমর্থন ছিল না কোনওকালেই। বরং তার বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই স্পষ্ট নিন্দা জানিয়েছেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version