এককালে ভারতীয় সঙ্গীতের দুনিয়ায় বইত এক আশ্চর্য বাতাস। সে বাতসে সুগন্ধ ছড়িয়ে দিতেন সুরের দুই প্রতিভাবান জাদুকর। সুরের আকাশে দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র ঝিকমিক করলেও, তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিতর্ক ছিল অনিবার্য। পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর উস্তাদ বিলায়েতের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। নানা বিতর্ক যেমন ছিল, সেতার নিয়েও ছিল নানা গল্প। দু’জনের সুর লাগানোর ক্ষেত্রে যেমন ফারাক ছিল, তেমনি যন্ত্রের পছন্দও ছিল আলাদা।

রবিশঙ্করের সেতার ছিল ফুলপাতার মোটিফে সাজানো। থাকত সাতটি মূল তার। খরজ-পঞ্চম এবং খরজের ‘সা’ ছাড়া থাকত ১৩ টি তরফ। ওপরে থাকত ছোট তুম্বা। আর বিলায়েতের পছন্দ সাজ-বিহীন, ছোট তুম্বাবিহীন, ন্যাড়ামাথা সাদামাটা চেহাড়ার সেতার। বাদ্যযন্ত্রটি যে কারিগরের হাতে তৈরি হত তাঁরই সাহায্য নিয়ে সেতারের গঠনকে, বিশেষত তবলী আর তারগহনকে বেশ সুদৃঢ় করে তুলেছিলেন বিলায়েৎ খাঁ। যাতে উচ্চ-স্বর পর্যন্ত মীড় দিতে গেলে তারের টানে অন্যান্য তারগুলি  সুর না হারিয়ে ফেলে। বাজনার ফাঁকে আবার নতুন করে যাতে তাদের বাঁধতে না হয়। কারণ সাধারণ সেতারের যা গঠন তাতে অনেকগুলি উচ্চ-স্বর পর্যন্ত মীড় দিতে গেলে তারের টানে অন্যান্য তারগুলির সুর হারানোর সম্ভাবনা থাকে, বাজনার ফাঁকেই তাদের নতুন করে বাঁধতে হয়। সেই ঝঞ্ঝাট এড়াতেই বিলায়েত বাদ্যযন্ত্র-নির্মাণ শিল্পীদের সাহায্য নিয়ে তাঁর সেতার গড়তেন। তাঁর সেতারের মূল তার ছিল ছ’টি। আর তরফ ১২টি।

বিলায়েত চাইতেন গান্ধার-পঞ্চম। সেতারের অন্যান্য কিছু তারকে এমন ভাবে বাঁধতেন, যাতে রাগের ফাঁকে ফাঁকে সেগুলি বাজিয়ে ভরাট করা যায়, এমনকি তানপুরার সাহায্য ছাড়াই বাজানো যায়। এই ধরণটাই ছিল বিলায়েত খানের সেতারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবলী অর্থাৎ নিচের গোলাকৃতি তুম্বার কাঠের ঢাকনা এবং তারগহন অর্থাৎ সেতারের কান থেকে বার হয়ে তারগুলি যেখান থেকে নিচে নেমে আসে সেগুলিকেও বাঁধতেন। তাছাড়াও সেতারের ঘাটগুলিকে তিনি যতটা সম্ভব বাঁকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন যাতে তার ও ঘাটের মধ্যে যথেষ্ট ফাঁক থাকে, যাতে তারকে টেনে পাঁচ-স্বর পর্যন্ত মীড় দেওয়া সম্ভব হয়। তিনিই ছ’টি তারের সেতার চালু করেছিলেন। অন্যান্য কিছু তারকে এমন ভাবে বাঁধতেন, যাতে রাগের ফাঁকে ফাঁকে সেগুলি বাজিয়ে ভরাট করা যায় এবং তানপুরার সাহায্য ছাড়াই বাজানো যায়। এইভাবে সেতারের দুনিয়ায সেকালে দু’টি ধরণে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে কেউ নিয়েছেন রবিশঙ্করের স্টাইল আর কেউ বিলায়েতের।

এ তো গেল বাজনার স্টাইলের ব্যাপার স্যাপার। আর বিলায়েত খাঁর যে নিজস্ব স্টাইল; সেও বা কম কী? ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সেতার ও সুরবাহার বাদক এনায়েৎ খান আর বশিরন বেগমের ছেলেটি মানুষ হিসেবেও ছিলেন অতি শৌখীন। মনের রঙকে সবসময়েই চাইতেন জীবনের রঙে মিশিয়ে দিতে। তাঁর আদবকায়দাও ছিল রঙে ভরপুর। দামী গাড়ি, দামী পোশাক, সন্ধেবেলায় দামী থ্রি-পিস স্যুট, মুখে যে পাইপ তাতেও দামী তামাক, তাছাড়া সঙ্গে থাকত এক টিন ৫৫৫ ব্র্যান্ডের সিগারেটৎ দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিক সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। সব কিছুতেই খরচ করতেন দরাজ হাতে। ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসতেন খুব। পোলো খেলা, সাঁতার, বলরুম ডান্স থেকে রান্না করে মানুষকে খাওয়ানো- সব ব্যাপারেই দারুন উতসাহী মানুষ ছিলেন। কলকাতায় থাকলে প্রায় প্রতি সন্ধেবেলায় দামী গাড়ি চড়ে গ্র্যান্ড হোটেলের নাইট ক্লাবে যেতেন। বলরুম ডান্সার বিলায়েৎ খাঁ একবার বেলজিয়ামে এক নাচের প্রতিযোগিতায় পেয়েছিলেন প্রথম পুরস্কার। গাড়ি চালানোর শখ ছিল। এক বার আফগানিস্তানের রাজা ওঁকে একটা মার্সিডিজ উপহার দিয়েছিলেন। সেটা ওঁর এতই পছন্দ ছিল যে নিজে চালিয়ে মুম্বই থেকে দিল্লি গিয়েছিলেন একটা প্রোগ্রাম করতে। বিলায়েত খানকে নিয়ে টুকরো টুকরো বহু গল্প আছে। এই নবাবী মেজাজের মানুষটাই সেতার নিয়ে বসলে চলে যেতেন একেবারে অন্য জগতে। আসরেও ছড়িয়ে দিতেন মনিমুক্ত। শুদ্ধ সুরের অলৌকিক অবগাহনে ভেসে আসত সৌন্দর্যের কারুবাসনা।

বিলায়েত খাঁ ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্ম-বিভূষণ সবকিছুই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অহঙ্কার নয়, তিনি মনে করতেন, সেতারের যে কোনও সম্মান প্রথম তাঁরই পাওয়া উচিত। ওঁর সমসাময়িক রবিশঙ্করের সঙ্গে ওঁর প্রতিদ্বন্দিতার কথা পত্রপত্রিকার পাতা জুড়ে থাকত। সেটাই স্বাভাবিক; অসামান্য দুই প্রতিভাশালী বাদক একই সময়ে সংগীত জগতে বিচরণ করলে এ ধরণের আলোচনা হবেই। তবে বিলায়েত খাঁ সেতারের কিংবদন্তি। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ইমদাদখানী ঘরানা, ইনায়েতখানী ঘরানা বা কখনো ইটাওয়া ঘরানার সেতারবাদক বলে। আসলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেই একটা ঘরানা হয়ে উঠেছিলেন। সেতারের দুনিয়া তাঁকে স্মরণ করবে উস্তাদ বিলায়েত খাঁ ঘরানা হিসেবে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version