বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস নির্মাতা ও পট শিল্পী

আমার জীবনের অনেক স্মৃতির মধ্যে দূর্গাপুজোর একটা স্মৃতি আমায় এখনও ভাবিয়ে তোলে, সে সময়টা আমরা কী ভাবে কাটিয়েছি। বছরটা হবে ১৯৮১। তখন আমার বয়স ১১ বছর। আমরা ছিলাম চার ভাই, আমি ছিলাম সেজ। বাবা ছিলেন পটল ফৌজদার। ঠাকুরের কাজে তিনি খুব দক্ষ ছিলেন। আর দশাবতার আঁকার কাজ তো ছিলই। সেই সময় বাবার ঠাকুরের কাজে খুব নাম-ডাক ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় শুধু নামই ছিল, টাকা পয়সা ছিল না। থাকার মতো ভালো বাড়িও ছিল না। সেই সময় বাবা প্রায় ১৮ থেকে ২০টির মতো দুর্গা প্রতিমা গড়তেন। যার জন্য বাবাকে খুব বেশি দেখতে পেতাম না। দিনের পর দিন বাবা ঠাকুরের কাজে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটেই যেতেন। মা, বাবার আশায় বসে থাকতেন, কখন বাবা টাকা নিয়ে আসবে আর আমাদের বাড়িতে ভাতের হাঁড়ি চাপবে।

বাবা একা রোজগেরে ছিলেন। তা ছাড়া তখন ঠাকুরের দাম ছিল না। এক একটা দূর্গা প্রতিমার দাম ছিল আট টাকা, দশ টাকা। ঘরের খরচ চালানোর জন্য বাবা সব কমিটির কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে নিতেন। পুজোর শেষে খুব একটা টাকা আর পাওয়া যেত না কমিটির কাছ থেকে। কারণ অগ্রিম টাকা নিয়ে নিয়ে সব খরচ হয়ে যেত। পুজোর সময় জামাকাপড় তো দূরের কথা, দুবেলা দুমুঠো খাওয়া জোটানোটাই ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিন তো এমনি হয়ছিল, মায়ের কাছে সংসার খরচের টাকা নেই। সে কথা বাবাকে বলায় বাবা সপ্তমীর দিন সকালে পাওয়া টাকা আদায়ের জন্য বেরিয়ে গেলেন। বাবা টাকা না-আনলে ভাতের হাড়ি চাপবে না বাড়িতে। সারাদিন কেটে গেল। বাবা কিন্তু বাড়ি ফিরল না। আমরা চার ভাই, মা তখনও না-খেয়ে।

বাবার অপেক্ষায় আমরা তখনও পথ চেয়ে বসে আছি যে কখন বাবা আসবে আর কখন আমরা খাবো। ক্ষিদেয় তখন পেট জ্বলছে। মাকে বললাম, মা আর থাকতে পারছি না। এই শুনে মা বলল, দোকানে গিয়ে চাল, ডাল ধার নিয়ে আসি। দেখি বলে, দেয় কি না। কিন্তু গরিব মানুষকে কে আর ধার দেবে। অবশেষে মা খালি হাতে ফিরে এলেন। রাত হয়ে গেল, বাবা তখনও ফেরেনি। মা পাশের বাড়ি থেকে ভাতের ফ্যান চেয়ে নিয়ে এল। আমাদের সবার সেদিন ভাতের ফ্যান খেয়েই সারারাত কাটাতে হয়েছিল। পরের দিন, অর্থাৎ অষ্টমীর দিন বাবা বেলা করে বাড়ি ফিরল, চাল, ডাল, সব্জি নিয়ে। সেদিন আমরা সবাই আনন্দ করে পেট ভরে খেলাম।

অনেক কথা এখনও বাকি রয়ে গেল।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version