টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় নাকি !

রাজা ব্যানার্জি | ছবি: ইন্দ্রনীল গাঙ্গুলি এবং রুদ্ররাজ দাষ

কলকাতা সত্যিই আড্ডার শহর। রকের আড্ডা থেকে পাড়ার চায়ের দোকানের ঠেক- শহরের সুনাম বা বদনাম দুইই জড়িয়ে তার সঙ্গেই। বালিগঞ্জ বিজন সেতুর কাছে আমাদের পাড়ারও একটা ঠেক আছে। পাড়ার একটি পরিবার সদ্য ঘুরে এসেছে দার্জিলিং থেকে। টাইগার হিল থেকে নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘায় দারুন সান রাইজও দেখেছে। আলোচনা চলছিল তা নিয়েই। ও পাড়ারই অরিন্দমদাও ছিল সেখানে। মাঝেমধ্যেই ট্রেকিং-এ যাওয়ার নেশা আছে তাঁর। এতক্ষন মনোযোগ সহকারেই তিনি শুনছিলেন সব আলোচনা।প্রজাপতি বিস্কুট আর চারটে কে ছটা বানানো চায়ের গ্লাসে এক চুমুক দিয়েই উনি বললেন, ধুস! টাইগার হিল থেকে আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় নাকি ! কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে হলে যেতে হবে সান্দাকফু। তবেই না দেখা যাবে, স্লিপিং বুদ্ধ। স্লিপিং বুদ্ধ? সেটা আবার কি ? এবার ব্যাখ্যা করলেন অরিন্দমদা। কাঞ্চনজঙ্ঘা তো পাশাপাশি পাঁচটি পর্বত চূড়ার এক সমষ্টি। সান্দাকফু থেকে দেখলে মনে হবে, যেন পাঁচটি পর্বতের শৃঙ্গ জুড়ে শুয়ে আছেন বুদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাকে ঘুমন্ত বুদ্ধ হিসেবে কল্পনা করলেও, হিন্দুরা অবশ্য মনে করে ঘুমন্ত শিব। বাঁদিকের দুটি শৃঙ্গ জুড়ে তাঁর মাথা, মধ্যিখানের শৃঙ্গটা পেট এবং ডান দিকের দুটি শৃঙ্গ জুড়ে তাঁর পা।


মনে গেঁথে গেল কথাটা। মনে মনেই ঠিক করলাম, একবার যেতেই হবে সান্দাকফু। আলোচনা হল স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে। আমি ছাড়াও আরো ছজন বললো, চল যাই। যাবো তো বটে, কিন্তু আমাদের মধ্যে একজন ছাড়া কারোরই এ অভিজ্ঞতা নেই।
নেই ট্রেকিং-এর উপযুক্ত সাজসরঞ্জামও। তাতে কি ! মহা উৎসাহে কেনা হলো রুকস্যাক, প্রবল ঠান্ডাকে বশ করানোর মতো গরম জামাকাপড়, ট্রেকিং-এর জুতো। জানুয়ারির এক রাতে চেপে বসলাম দার্জিলিং মেলে। জীবনের প্রথম ট্রেকিং। মনে উৎসাহের যেন আর শেষ নেই। রাতের খাবারের জন্য কেউ এনেছে লুচি তো কেউ আলুর দম। কারো বাড়ি থেকে এসেছে চিকেন কষা তো কারো বাড়ি থেকে এসেছে পিঠে। খেতে খেতেই চললো আড্ডা। আমরা যেন ফিরে গেলাম বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের দিনগুলোয়।


পরের দিন সকাল বেলা নামলাম নিউ জলপাইগুড়ি। স্টেশনের বাইরে পেট ভরে জলখাবার খেয়ে উঠে পড়লাম জিপ এ। সবার রুকসাক গুলো সযত্নে দড়ি দিয়ে গাড়ির ছাদে বেঁধে দিল ড্রাইভার। রওনা হলাম দার্জিলিং যাবার পথেই। পাঙ্খাবাড়ি পৌঁছানোর একটু আগে জিপ বাঁ দিকে ঘুরে চললো মানেভঞ্জন যাবার পথে।


সান্দাকফু যাবার বেস পয়েন্ট হল মানেভঞ্জন। সেখান থেকেই শুরু হয় ট্রেকিং, সংগ্রহ করতে হয় পাস। সঙ্গে একজন পোর্টার কাম গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। সান্দাকফু যাবার দুটি রাস্তা রয়েছে। বাম দিকের পথটায় গাড়ি চেপে চলে যাওয়া যায়। বোল্ডার বিছানো পাহাড়ি রাস্তা। একমাত্র ল্যান্ড রোভারই চলে সে পথে। মানেভঞ্জন, চিতরে, টামলিং হয়ে সান্দাকফু। আরো একটি পথ আছে সে দিকেই। মানেভঞ্জন থেকে ধোতরে, টংলু, টামলিং হয়ে সান্দাকফু। আমরা ঠিক করলাম, ধোতরে হয়ে যাবো। আর ডানদিকের রাস্তাটা রিম্বিক, শ্রীখোলা, গুরদুম হয়ে যাচ্ছে সান্দাকফু। ঠিক হলো, ও পথে ফিরবো আমরা। গাড়িতে ধোতরে পৌঁছতেই বেলা তিনটে বাজলো। আমাদের গাইড থাপা বললো, আজ আর এগোনো যাবে না। রাতে আমাদের থাকতে হবে এখানেই। সেখানে হোম স্টে-তে যে বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো, সেটাও বেশ সাজানো গোছানো কাঠের বাড়ি। আমাদের ঘরগুলো ছিলো খাদের দিকে মুখ করা। রাস্তার ঠিক উল্টোদিকেই বাড়ির মালিকের সপরিবারে বাস। সেদিনের মতো ফ্রেশ হয়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বসলাম খাদমুখো কাঠের ব্যালকনিতে। বইছে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। হঠাৎ খেয়াল করলাম, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নেমেছে যেন। ভুলটা ভাঙলো অল্প সময়ের মধ্যেই। গাছের মাথাগুলো ক্রমশ যেন সাদা হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি তো নয়, এতো বরফ পড়তে শুরু করেছে।


সামনে বরফ পড়তে দেখার কোনো অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। অনেক জায়গাতেই গিয়েছি। কিন্তু সেখানে দেখেছি, আগেই বরফ পড়ে এলাকাগুলো সাদা হয়ে রয়েছে। সবাই মিলে প্রত্যক্ষ করলাম সে অপূর্ব দৃশ্য। ওই সমস্ত এলাকায় রাতের খাবার তাড়াতাড়ি সারাই দস্তুর। রাত না-বাড়িয়ে আমরাও গরম গরম ভাত, ডাল, আলুভাজা আর মুরগির ঝোলে ডিনার সেরে নিলাম। গাইড বললো, আজ বেশি রাত না-করাই ভালো।
কাল সকাল থেকে শুরু হবে পাহাড়ি পথে আমাদের পথচলা।

চলবে…

Share.

2 Comments

  1. Amrita Mitra on

    চোখের সামনে ভাসছে পুরো জার্নি টা । পরের পর্বগুলোর অপেক্ষায় থাকলাম । ?

Leave A Reply

Exit mobile version