এসকোবার মেডেলিনের গরিব মানুষদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন একজন ‘ভালো ডাকাত’। তার পিছনে যথেষ্ট কারণও ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোটা সময় ধরে কলম্বিয়া ডুবে ছিল দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সম্পদের প্রকট বৈষম্যের মধ্যে। ধনী রাজনীতিবিদরা গরীব মানুষদের ব্যবহার করলেও গরীবরা কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা পেত না। তাই ডাকাত হলেও এসকোবার অনেক কলম্বিয়ানের কাছেই ‘ডন পাবলো’ হিসেবে সম্মান লাভ করেছিলেন। মেডেলিনের সাধারণ জনগণও এসকোবারকে তাদের নিজেদের মানুষ ভাবতো। যদিও এসকোবার যে তাঁর দাতব্য কর্মসূচিকে তাঁর নিজের ব্যবসার খাতিরেই করতেন তা বলার দরকার পড়ে না।মেডেলিনের বিশাল গরীব জনসমষ্টিকে ব্যক্তিগত ব্যবসা, নিরাপত্তার কারণে ব্যবহার করার জন্যই ‘জনগণের বন্ধু’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করতয়ে এসকোবার একটি সংবাদ সংস্থাও খুলেছিলেন, যেখানে এসকোবারের দাতব্য কর্মসূচিকে তুলে ধরা হত।

প্রায় ৫ লক্ষ লোক এসকোবারের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থনীতি’-র উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু তারা কি সবাই নিজের আগ্রহেই সেই কাজে নিজেদের নাম লিখিয়েছিল? না তেমনটা ধরে নেওয়া যাবেনা।কলম্বিয়ার সাধারণ কৃষকদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। যদি না তারা আশানুরূপ কোকেন উৎপাদন করতে পারতো, বলাই বাহুল্য বেশির ভাগেরই তা না করে কোনও উপায় ছিল না। যেসব পুলিশ অফিসার আর রাজনীতিবিদ ঘুষ নিতে অস্বীকার করতো,  তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মাথায় গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতো। ধরা হয়,  এসকোবারের কোকেন ব্যবসার কারণেই কলম্বিয়ায় দৈনিক কম করে হলেও ২০ জন মানুষ খুন হত!

১৯৮৯ সালে, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী লুই কার্লোস গালান ঘোষণা করেন তিনি প্রেসিডেন্ট হলে কলম্বিয়া থেকে মাদকের ব্যবসা সমূলে উৎপাটন করবেন। এ কথা ঘোষণা করার কয়েকদিন পরেই গালানের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। এসকোবারের আদেশে গালানের উত্তরাধিকারী সিজার গ্যাভিরিয়াকেও খুন করার চেষ্টা করা হয়। গ্যাভিরিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানে বোমা রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেই বোমা বিস্ফোরণে ১০৭ জন যাত্রীর সবাই মারা যায়, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে গ্যাভিরিয়া সেখানে উপস্থিত না থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার পরের বছরই গ্যাভিরিয়া কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, আর তার পর থেকেই এসকোবারের আন্ডারগ্রাউন্ড শাসনের সূর্য অস্তমিত হতে শুরু করে।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই এসকোবার আন্তর্জাতিক আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ার্ল্ডে খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করেন, একজন আন্তর্জাতিক ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল’-এর তালিকাতেও তাঁর নাম উঠে গিয়েছিল। আমেরিকা এবং কলম্বিয়া যৌথ উদ্যোগে তাঁকে ধরবার জন্য ব্যবস্থা নেয়। ধরা পড়লে কলম্বিয়া সরকার তাঁকে আমেরিকার হাতে তুলে দেবে- এমনটাই আইন করা হয়। কলম্বিয়ার এই আইন পালটে দেওয়ার জন্য এসকোবার রাজনীতিতেও নাম লেখান, যদিও তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। রাজনীতিতে ব্যর্থ হওয়ার পর এসকোবার অন্য রাস্তা ধরেন।তিনি কলম্বিয়ার আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করে দেবেন বলে ঘোষণা করেন, যার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! সেই সময় কলম্বিয়ার বৈদেশিক ঋণ ছিল ১০০০ কোটি ডলার। সেই ঋণ কয়েক ঘন্টার মধ্যে মিটিয়ে দেবেন বলেছিলেন এসকোবার। শর্ত ছিল একটাই, তাকে কোনওদিন আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়া চলবেনা। কিন্তু এই ভাবে ঋণ শোধ হলে খুনের রক্ত লেগে যাবে, তাইতা নিতে চায়নি কলম্বিয়া।

কলম্বিয়ার গরিব মানুষ এসকোবারকে ‘রবিনহুড’ নাম দিয়েছিল। কারণ, এসকোবার প্রতি মাসে গরিবদের মধ্যে প্রচুর টাকা বিলিয়ে দিতেন। তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে এসে কেউ কোনও দিন ফিরে যাননি। হাজার হাজার গৃহহীনকে বাড়ি করে দিয়েছিলেন। নিজের পয়সায় কয়েকশো জমি কিনে, ফুটবল মাঠ তৈরি করে উপহার দিয়েছিলেন কিশোরদের। এসকোবার ফুটবল প্রেমী ছিলেন। তৈরি করেছিলেন একাধিক স্টেডিয়াম। স্পনসর করতেন কলম্বিয়ার কয়েকশো ফুটবল ক্লাবকে। সেগুলির একটিও নামী ক্লাব ছিল না। এই ভাবে কলম্বিয়াতে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এসকোবার। ১৯৮২ সালে কলম্বিয়ার সাংসদ হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু অপরাধ জগতের সঙ্গে যোগ থাকায় দুই বছরের মধ্যে তাঁকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল। যে আইনমন্ত্রীর জন্য এসেকোবার ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনি কয়েকদিনের মধ্যেই খুন হয়ে গিয়েছিলেন। সে খুনের নেপথ্যে যে ছিলেন এসকোবার তা বলাই বাহুল্য।

কোথায় কত সম্পত্তি ছিল তা এসকোবার নিজেই জানতেন না। সবচেয়ে বিখ্যাত সম্পত্তিটি ছিল বোগোটা ও মেডেলিনের মাঝখানে ৭০০০ একরের ‘হাসিয়েন্ডা নাপোলেস’ এস্টেট। যেটি বানাতে এসকোবার খরচ করেছিলেন ৬৩০ কোটি ডলার। এস্টেটের প্রবেশ দ্বারের মাথায় বসানো ছিল সেই বিমানটি, যেটিতে এসকোবার আমেরিকায়ড্রাগ পাচার করতেন। ‘হাসিয়েন্ডা নাপোলেস’ এস্টেটের ভেতরে ছিল আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল মাঠ, ডাইনোসর স্ট্যাচু, কৃত্রিম হ্রদ, বুলফাইটিং এরিনা, টেনিস কোর্ট, বিশাল গ্যারেজে রাখা থাকত শয়ে শয়ে বিলাসবহুল গাড়ি। এস্টেটের ভেতরে ছিল এসকোবারের নিজস্ব বিমানবন্দর। এত কিছুর মধ্যে এসকোবারের সবচেয়ে পছন্দের জিনিস ছিল একটি চিড়িয়াখানা। যে চিড়িয়াখানাটিতে ছিল প্রায় ২০০ টি পশু। যাদের মধ্যে ছিল বাঘ, সিংহ, হাতি, জেব্রা, জলহস্তী, উট, জিরাফ সহ নানান প্রজাতির পশুপাখি ও সরীসৃপ। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা হত পশুগুলিকে। ড্রাগ পাচারের জন্য ব্যবহৃত কার্গো বিমানগুলি।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version