সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল পরবর্তী বাংলা সিনেমার মরুভূমিতে ঋতুপর্ণ ঘোষকে মরূদ্যান বলতে হবে। যিনি চটকদার ছায়াছবির প্রহেলিকা থেকে অনেকটা সরে মধ্যবিত্ত জীবন, নারীর অবস্থান কিংবা সামাজিক যৌন অবদমনের জায়গাগুলি তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন।

বিনোদনের চটকের পরিবর্তে মানুষের কথা, মনোজগতের কথা বলতে চেষ্টা করতেন। চলচ্চিত্রের ভাষা যে তাঁর আয়ত্তাধীন সেটাও তাঁর ছবির দৃশ্য রচনা থেকেই বোঝা  যেত। ছোটবড় দৃশ্যের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করতেন দ্বন্দ্ব। সামান্য একটি ইঙ্গিতে খুলে যেত আপাত গোপন মনোজগতের দরজা। দৃশ্যের পর দৃশ্য তার শব্দকল্প ধরে দর্শক চলে যেতে পারেন ভাবনার সিঁড়িতে। পৌঁছে যেতে পারেন মানবিক অনুভূতির শিখরে।

তাঁর ছবিতে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের বাইরের সম্পর্ক, নারীর ক্রমশ নারী হয়ে ওঠা– এসবই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে। ঋতুপর্ণর সিনেমা দর্শককে আন্দোলিত করতে পেরেছিল। তাদের মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন। প্রচলিত ধারাকে তিনি অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইতেন; আর সেই ছবিটাই তিনি দেখাতে চাইতেন।

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে তিনি বাঙালি শিক্ষিত সমাজকে ফের প্রেক্ষাগৃহে ফেরাতে পেরেছিলেন। মধ্যবিত্ত বাঙালি তাঁর ছবিতে খুঁজে পেয়েছিল তাদের চেনা ছবিকেই এক অচেনা আঙ্গিকে। ওই চেনা গল্পের পরিসরে তিনি তাঁর জ্ঞানচর্চার ওজস্বিতায় লুকিয়ে রাখা, এড়িয়ে চলার ভাষা, অবহেলার ছবিকে যখন দর্শকদের সামনে এনে হাজির করতেন, তখন তাঁর সেই সবকিছু তৈরি করত এক সামাজিক স্বর। যে-স্বরের স্পর্ধিত কণ্ঠ আজ মেনস্ট্রিম সিনেমার বিষয়।

বাংলা ছবির এই আনকোরা সময়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ নিঃসন্দেহে আধুনিক এবং অন্য। তিনি নিজেই নিজের ব্র্যান্ড। লেখক, পরিচালক, অভিনেতা সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল ও বিতর্কিত নায়ক। বাঙালির মনোজগৎকে সেলুলয়েডে বন্দি করে তিনি বাংলা ছবিকে পৌঁছে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে।

নির্মাতা হিসেবে  প্রথম কাজ হিসেবে আমরা সবাই জানি হীরের আংটির কথা। কিন্তু হীরের আংটির কয়েক বছর আগে ১৯৮৮—৮৯ সালের দিকে টেলিভিশনের জন্য নির্মিত ‘বন্দেমাতরম’ নামের ডকু—ফিচার নির্মাণের মাধ্যমে ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র নির্মাণের হাতেখড়ি।

১৯৯২ থেকে ২০০২ চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণের ক্যারিশমার কাল। হীরের আংটি, ১৯ এপ্রিল, দহন, বাড়িওয়ালি, অসুখ, উৎসব, তিতলি ও শুভমহরত চলচ্চিত্রগুলো একদিকে যেমন তাকে দিয়েছিলো জনপ্রিয়তা, অন্যদিকে ঘরে এসেছে পুরস্কার ও সমালোচকদের প্রশংসা। এসময়ের সবগুলো চলচ্চিত্রই জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত। এমনকি প্রতিটি চলচ্চিত্রেই পরিচালকের নিজস্ব রুচিবোধ ও যত্নের ছাপ স্পস্ট। চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো পোষাক নিবার্চন থেকে শুরু করে মেকআপ, সেট, সংলাপ এমনকি উপস্থাপনার ধরণে খাঁটি বাঙালি শহুরেপনার ছাপ স্পস্ট হয়ে ধরা দিত। ঝকঝকে নির্মাণ ও সাবলিল উপস্থাপনা খুব সহজেই আকৃষ্ট করে শহুরে বাঙালির মন।

২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পরিচালক ঋতুপর্ণের নির্মাতা জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। এই সময়ে তিনি যতগুলো ছবি করেছেন তার প্রায় সবগুলোতেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা গেছে কোনও না কোন বলিউড তারকাকে। ঐশ্বরিয়া রায় অভিনীত চোখের বালি, তারপর রেইনকোট-এ অজয় দেবগন,  অন্তরমহল-এ জ্যাকি শ্রফ, সোহা আলী খান, অভিষেক বচ্চন, দ্য লাস্ট লিয়র-এ অমিতাভ বচ্চন, প্রীতি জিন্তা, অর্জুন রামপাল, সব চরিত্র কাল্পনিক-এ বিপাসা বসু, খেলা-এ মনীষা কৈরালা অভিনয় করেছেন। এই সময়ের ছবিগুলি একদিকে যেমন ঋতুপর্ণ ঘোষকে বিতর্কিত করে তুলেছিল, অন্যদিকে এই ছবিগুলি কিন্তু তেমন একটা দর্শকপ্রিয়তা পায়নি।

২০০৯ সাল থেকে শেষ পর্যন্ত সময়টা পরিচালক ঋতুপর্ণের চেয়ে ব্যক্তি ঋতুপর্ণ বড় হয়ে ওঠেন ক্রমশই। যদিও আবহমানের মাধ্যমে আবার দূর্দান্তভাবে ফিরে এসেছিলেন, শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার এসেছিল। সেই সঙ্গে সমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসাও। কিন্তু নৌকাডুবির পর থেকে অন্য পথে হাঁটলেন পরিচালক ঋতুপর্ণ। পরিচালক ঋতুপর্ণ ঢাকা পড়ে গেলেন ব্যক্তি ঋতুপর্ণের আড়ালে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি প্রেমের গল্প ও সঞ্জয় নাগের মেমরিজ ইন মার্চ তাকে ঠেলে দিলো অন্য জগতে। নির্মাণ করলেন চিত্রাঙ্গদা। একই সঙ্গে অভিনয়ও করলেন। এটাই তার পূর্ণাঙ্গ শেষ চলচ্চিত্র।

বায়োলজিকাল কারণে ঋতুপর্ণ ঘোষ এফিমিনেট ছিলেন। আমাদের সমাজে এফিমিনেটরা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। সমাজেও তাদের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। কিন্তু কাজ ও উদ্দমতার গুণে তিনি তা উতরে গিয়েছেন এবং এফিমিনেটদের জন্য পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছেন। কৌশিকের আরেকটি প্রেমের গল্প এর অবিরূপ সেন ও সঞ্জয়ের মেমোরিজ ইন মার্চ এর সিদ্ধার্থের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জীবণাচরণের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই হয়তো তার এ পর্যায়ে আত্মনিমগ্নন। 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version