খুব কম ছেলেমেয়েই লেখাপড়ায় মনযোগী হয়।জগজিৎ সিং-এরও লেখাপড়া একেবারেই ভালো লাগত না।জগজিৎতখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। রাজস্থানের একটি গানবাজনার অনুষ্ঠানে গান গাইবার সুযোগ পেয়ে জগজিৎনিজের সুর করা একটি পাঞ্জাবী গীত পরিবেশনকরেন।সেদিনওইঅনুষ্ঠানে হাজির থাকা প্রতিটি দর্শক তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুগ্ধ স্রোতাদের কাছ থেকে জগজিৎসম্মানিক হিসাবে পেয়েছিলেন ১২৫ টাকা। এই ঘটনা তাঁকে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

ওই সময় থেকে সঙ্গীতই জগজিতের প্রাণসখা হয়ে উঠছিল। ক্লাসিক্যাল যেমন তাঁরভালো লাগত, তেমনি ভালো লাগত পাঞ্জাবি লোক সঙ্গীত, টপ্পা আর সিনেমার গান। কিন্তুসিনেমার গান তাঁর বাবার একেবারেই পছন্দ ছিল না। শুধু জগজিতের বাবা কেন, তখন যারাই ক্লাসিক্যাল চর্চা করতেন, তাঁদের কেউই সিনেমার গান বা লঘু সঙ্গীতকে খুব একটা সুনজরে দেখতেন না। আর সিনেমার গানে জগজিতের ছিল অদম্য এক আকর্ষণ। লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখে ধরা পড়ে বাবার হাতে যেমন প্রায়শই  উত্তম-মধ্যম খেতেন অন্যদিকে সিনেমার গান গাইতে গিয়ে জুটতো গুরু ছগনলালের খড়ম। তবু সিনেমার গানের প্রতি জগজিতের ভালোবাসা থেকেই গিয়েছিল। জগজিৎপরবর্তীতে সেই ভালোলাগা সিনেমার গানগুলি রেকর্ডও করেছিলেন। 

গুরু ছগনলালের কাছে ক্লাসিক্যালের পাঠ শেষ করে ওস্তাদ জামাল খাঁ সাহেবের কাছে খেয়াল-ঠুংরি ধ্রুপদের তালিম নেন। কলেজ ছাত্র জগজিত সিং জলন্ধর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে বি-গ্রেড শিল্পীর স্বীকৃতি পান। নিজের সুরে রেডিওতে গাওয়া “গুম সুম ইয়ে জাহা হেয়/ হাম দাম তু কাহা হেয়/গাম জাদা হো গেয়ি/ জিন্দেগী আভি যা” খুব জনপ্রিয় হয়। কলেজ জীবনে জগজিৎ সিং-এর আরেকটি অসামান্য গান “রুখছে পর্দা উঠাদে জারা সাকি, বাছ আভি রাঙ্গ মেহফিল বাদাল যায়েগা”।আনোয়ার মির্জাপুরীর লেখা এই গজলটির সুরও তাঁর নিজের। এত কম বয়সে যে এতপরিণত ও উঁচু মানের সুর সৃষ্টি শুনলে বিস্মিত হতে হয়।

এরপরই একদিন বাড়িতে কাউকে কিছু না-জানিয়েই মুম্বাই পাড়ি দিলেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে লড়াই করলেন কিন্তুকিচ্ছু হল না। পকেটের রেস্ত ফুরিয়ে যেতেই বাড়ি ফিরলেন। প্রথম সফরে ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়েন নিজ জগজিৎ।ফের একবার চেপে বসলেন পাঠানকোট এক্সপ্রেসে। এবারও পকেটে টানাটানি কিন্তুদাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালালেন একটা সুযোগের আশায়, দু’বেলা পেট ভরে খাবার আশায় পার্টিতে, জলসায় ফিল্মি গান, গজল, পাঞ্জাবি টপ্পা গাইতে শুরু করলেন।যোগাযোগ হল এইচ এম ভি’র সঙ্গে। একটি ইপি-তে গাইলেন ‘আপনা গম ভুল গয়ে’ আর ‘আঁখ কো জাম সমঝ বৈঠা থা’

সুরকার হিসেবে জগজিৎ-এর প্রথম আত্মপ্রকাশ রাজেন্দ্র মেহতার একটি গান দিয়ে।তাঁর হাত ধরেই শুরুহল ভারতীয় গজলের নতুন ধারা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নির্ভর গজলকে সময়োপযোগী করে শ্রোতাদের মনোপ্রিয় করার পরীক্ষা চালাতে থাকলেন তিনি। গজলের মেজাজ অক্ষুন্ন রেখে তিনি ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের অসাধরন মিশ্রণে সৃষ্টি করলেন এক অদ্ভুত আবহ। ঐতিহ্যবাহী দেশীয় বাদ্য যন্ত্র তবলা, ঢোলক, বঙ্গো, সিতার, সন্তুর, বাঁশী, হারমোনিয়ামের পাশাপাশি পাশ্চাত্যের গিটার ও কী-বোর্ড যোগ করে রীতিমত বিপ্লব ঘটালেন। জগজিৎ গজলে পাশ্চাত্য সঙ্গীত-যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ালেন, প্রিল্যুডের পরিবর্তে কোথাও কোথাও কোরাস ব্যবহার করলেন, তিনি সহজ কথায় গভীর ব্যঞ্জনা আছে যেসব গজলে সেগুলি নির্বাচন করলেন। তাঁর আগে প্রচলিত ছক ভেঙে এভাবে ভাবার সাহস করেননি কেউ। একমাত্র তিনিই মেহফিলের গজলকে নিজের করে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন।

তবে যে কণ্ঠ স্বরের জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন সেই কণ্ঠের জন্যই তিনি বলিউডে সেভাবে জায়গা পান নি। কারণ হিসাবে বলা হয়; তখন মহম্মদ রফি, কিশোর ও মুকেশের বাইরে অন্য কারও কণ্ঠ বলিউড হিরোদের ঠোঁটে চলতে পারে এ কথা কেউ ভাবতেই পারতেননা। তবে লতা মঙ্গেশকর রেডিওতে জগজিৎ-এর গজল শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি নিজে মদন মোহনকে ছবির গানে জগজিৎকে নিতে অনুরোধ করেছিলেন। জয়কিষণও একবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুম্বাই ফিল্মে জগজিৎ-এর কণ্ঠ বেমানান, এই যুক্তিতে মুম্বাইয়ের ছবিতে গান গাইতে না পেরে জগজিৎ জলন্ধর ফিরতে বাধ্য হন। সেই সময় তাঁর কাছে টিকিট কেনারও টাকাও ছিলনা। ফলে মুম্বাই থেকে জলন্ধর তাঁকে বিনা টিকেটে ট্রেনের বাথরুমে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল।পরবর্তীতে অবশ্য বলিউড তাঁকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করে।

প্রসঙ্গত; মুম্বাইয়ের ব্যর্থতা ভারতের গজলের জন্য যেন শাপে বর হয়। জগজিৎ-এর সুরের যাদুতে গজল ফিরে পায় নতুন জীবন। মির্জা গালিব থেকে শুরু করে গুলজার, কায়ফি আজমি, ফিরাক গোরখাপুরী, কফিল আজার, নিদা ফাজলি, সুদর্শন ফকির, কাতিল শিফায়ী প্রমুখ উর্দু কবিদের গজল তাঁর কণ্ঠের যাদুতে পেয়েছে জীবন। বলিউডের প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবে যদি সুযোগ পেতেন, তাহলে গজলের অবতার হিসাবে জগজিৎকে আমরা পেতাম না। সিনেমার গানের আড়ালে হয়ত হারিয়ে যেত জগজিৎ-এর রাগাশ্রয়ি গজল।
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version