মাঝরাতে আচমকা পুলিশের হানা।ঘটনাস্থল গড়িয়াহাট মোড়ের'যশোদা ভবন'।গোপন সূত্রে পুলিশ খবর পেয়েছে ওই বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছে দু-একজন কমিউনিস্ট। তখন সারা দেশে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ।পুলিশের কাছে খবর আছে ওই বাড়িটিতে আশ্রয় নিয়ে আছে এমন একজন যুবক; যার বিরুদ্ধে ‌তিনটে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে। ওই তরুণটির নাম বাচ্চু। অসমের নওগাঁ-এর ছেলে।কলকাতার কলেজে পড়াশোনা করতে এসেছে।আছে ওই বাড়িরই দুই তরুণ ভূপতি ও সুরপতির আশ্রয়ে।

তবে সে রাতেও বাচ্চু পুলিশের জালে ধরা পড়েও বেঁচে গেল।সে কেবলমাত্র ভূপতি ও সুরপতির মা কিম্বা গৃহকর্তীর কারণেই।ওই বাড়ির দুই তরুণ ভূপতি ও সুরপতি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। অসমের নওগাঁ থেকে আসা বাচ্চুও তাই।যে শুধুমাত্রসে রাতেই নয়, ‌আগেও অন্তত দুবার গ্রেপ্তার হতে হতে বেঁচে গিয়েছিল।প্রথমবার মহম্মদ আলি পার্কে ছাত্র সমাবেশে গান গাওয়ার পর পুলিশ পিছু নিয়েছিল। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা টের পেয়েই কোনওরকমে তাদের হস্টেলে নিয়ে গিয়ে তাঁকেলুকিয়ে রাখে।

পরেরবারের ঘটনা; বাচ্চু তখন থাকেন সার্কুলার রোডের এক ডেরায়। ট্রামে করে ফিরছিলেন, এদিকে বাচ্চুকে ধরতে পুলিশ আগে থেকেই সেই ডেরায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। খবর পাওয়া মাত্র কমরেড কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাচ্চুর ফেরার পথে হাজির হয়ে যায়। মাঝ পথে ট্রাম থেকে নামিয়ে নিয়ে একেবারে অন্য ডেরায় পৌঁছে দেয় বাচ্চুকে। 

সেই মাঝরাতেও ভূপতি-‌সুরপতির মা পুলিসকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন, যুবকটি তাঁর ছেলে, নাম নৃপতি, সেদিনই সে নবদ্বীপ থেকে এসেছে। তখন ঠিকানা প্রমানের জন্য আধার কার্ড ছিল না কারণ; সময়টা গত শতাব্দীর মাঝামাঝি।কিন্তু তিনি নিজের দুই ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি। পুলিশ সে রাতে কমরেড ভূপতি আর সুরপতিকে গ্রেফতার করে।

তখন পর্যন্ত বাচ্চু নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টিতে বাচ্চু নামেই পরিচিত,অনেকে বাচু নামেও ডাকতেন। বাচ্চু বা বাচুর আসল নাম সলিল চৌধুরী। তবে ততদিনে বাচ্চুর লেখা ও সুর করা গান ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’, ‘হেই সামালো ধান হো’ বাংলার মাঠ ময়দান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে অসমের চা বাগিচায়। তবে কলকাতায় প্রকাশ্যে বাচ্চুর চলাচল নিরাপদ নয়।অতএববাচ্চুকে গাঢাকা দিতে হল। এবার বাচ্চুর ডেরা হল সন্দেশখালির ভাঙড়।

প্রায় বছরখানেক গাঢাকা দিয়ে কলকাতা ফিরে এক অদ্ভুত অভিঙ্গতার মুখোমুখি হলেন বাচ্চু ওরফে সলিল। সেটা দুর্গা পুজোর সময়, পুজো প্যান্ডেলে মাইক বাজছে, সেই গান হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো রূপকথা নয় সে নয়’। মনে পড়ল যশোদা ভবনের ঘটনার কয়েকদিন আগে ভূপতি নন্দী তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। অনেক গানের মধ্যে একটা-‌দুটো গান পছন্দ হয় হেমন্তর। তখন পুরো গানটা লেখাও হয়নি। তবে হেমন্তের পছন্দ হওয়ায় দু’দিনের মধ্যেই সলিল লিখে সুর করলেন। আর যে সন্ধেয় তা হেমন্তর গলায় তুলে দিয়ে এলেন, সেদিন রাতে যশোদা ভবনে পুলিস এল। সলিল সুর করলেও অর্কেস্ট্রেশন করা হয়নি। সে কাজ হেমন্ত নিজেই করেছেন!‌ রেকর্ডে কথা ও সুর লেখা আছে সলিল চৌধুরি।

এমন ঘটনা প্রথম হলে তারপরও ঘতেছে। সলিলকে ফের আন্ডারগ্রাউন্ড-এ যেতে হয়। সুকান্ত-র কবিতা ‘রানার’ সুর করে হেমন্তের হাতে দিয়েছেন। সলিল নেই, অর্কেষ্ট্রেশন করে রেকর্ড করেছেন হেমন্ত। অথচ যে কমিউনিস্ট পার্টি-র জন্য সলিলের বিরুদ্ধে ‌তিনটে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, আন্ডারগ্রাউন্ড-এ গা ঢাকা দেওয়া তাঁরাই একদিন কিন্ত সলিল চৌধুরির গানের কথা নিয়ে অভিযোগ তুললেন, সলিলের গানে ‘উত্তরণের’ চিহ্ন নেই কেন?

গাঁয়ের বধূর শেষে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলা দেখিয়েছেন তিনি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ গানটিতে ‘হায় বিধি বড়ই দারুণ, পোড়া মাটি কেঁদে মরে ফসল ফলে না’ ‘হায় বিধি’ মানে তো ‘ঈশ্বরবাদ’ কিম্বা ‘ভাগ্যবাদ’, সেটাই কি প্রচার করা হচ্ছে?‌ উত্তরে সলিল বলেছিলেন, ‘তাহলে ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে’ কীভাবে গাওয়া হয়?’ উত্তর, ‘ওটা প্রচলিত গান’। অতএব গাঁয়ের বধূ গানটিকে তৎকালীন ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা ‘নেতিবাচক’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ঘোষণা করলেন। প্রশ্ন, সলিলের গানের সাফল্যকেই কি মন থেকে মানতে পারেন নি গোঁড়া হিঁদু মনোভাবাপন্ন কমিউনিস্ট নেতারা,নাকি মন ও মনন অতটা দৈন্য না হলে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা হওয়া যায় না?

Share.

2 Comments

  1. অন্যের সাফল্য তথাকথিত মার্ক্সবাদীদের ভীষণ যন্ত্রণা দিত, তিনি মার্ক্সবাদী হলেও সফল হওয়ামাত্র প্রতিক্রীয়াশীল হয়ে যেতেন, তাই সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, সোমনাথ হোড় প্রমুখ দলে থাকতে পারেন নি।

  2. prasanta hazra on

    গানের কারিগর সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মেলবন্ধনে যখন এমন সব গান তৈরি হয় তখন তৎকালীন কম্যুনিস্ট নেতারা মনে প্রাণে এত ভিখারি হন কিভাবে, এরাই
    পরবর্তীতে মানে ১৯৭৭-৭৮ থেকে চুরি ডাকাতিতে ওস্তাদ হয়ে উঠোলেন

Leave A Reply

Exit mobile version