শৈশবে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ালেখা। আশুতোষ কলেজে পড়াকালীন ছাত্র পরিষদ করতেন। তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়। ম্যানেজমেন্টও পড়েছেন,বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চাকরি করেছেন বহুজাতিক সংস্থায়। তিনি অ্যান্ড্রু ইউল সংস্থার এক জন এইচ আর প্রফেশনাল। কিন্তু একদিন সে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন রাজনীতিতে। তৃণমূল কংগ্রেসের শুরুর দিন থেকেই তিনি মমতার সঙ্গে আছেন। তাঁর ডাকনাম ‘কাতু’। আর নাকতলার বাড়িটির নাম ‘বিজয়কেতন’।এই মুহুর্তে তিনি বাংলার ইতিহাসে সবথেকে বড় দুর্নীতিপরায়ণ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং শিল্প ও বাণিজ্য, তথ্য ও প্রযুক্তি, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা, শিল্প পুনর্গঠন ও পরিষদীয় বিভাগের মন্ত্রী।

২০০১ সালে তিনি বেহালা পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে ফের তিনি ওই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। ২০১১ সালেও তিনি বেহালা পশ্চিম থেকেই ৫৯,০২১ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে একটানা তৃতীয়বারের জন্য বিধায়ক নির্বাচিত হন। ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ছিলেন। উল্লেখ্য, বিরোধী দলনেতার মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা রাজ্যের যে কোনও ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান।প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়লাভ করে সরকার গঠন করার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা ও স্কুলশিক্ষা বিভাগের মন্ত্রী হন।

এমনিতে পার্থবাবু খুবই ভদ্র স্বভাবের মানুষ। ব্যবহারে আন্তরিক, আলাপচারিতায় বৈঠকী এবং অতিথিবৎসল। হয়ত সে কারণেই মেয়ের বিয়েতে আত্মীয়-বন্ধু-পরিচিতদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে দুদিন লেগে যায়। আয়োজন দেখেও তাঁর দরাজ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। স্ত্রী এবং মায়ের পারলৌকিক ক্রিয়াতেও আত্মীয়-বন্ধু-পরিচিতরা ঢালাও আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। তখনও ছিল বিশাল আয়োজন- শ্রাদ্ধবাসরে ফুলের সজ্জা থেকে শুরু করে শহরের অন্যতম রেস্তোঁরার শেফ দিয়ে রান্না… নিজের দলের লোকজনেরই চক্ষু চরক গাছ করে ছেড়েছিলেন। কিন্তু সেদিন কি দলের কারও মনে এই প্রশ্ন জেগেছিল, এত টাকা আসছে কোত্থেকে? নাকি সবাই এমনটাই ভেবেছিলেন, দলের কাউন্সিলাদেরই যে পরিমান কলাটা-মুলোটা জুটছে সেখানে একজন ওজনদার নেতা-মন্ত্রীর তো জমে পাহাড় হবেই। 

পার্থগত ১১ বছর ধরে রাজ্যের মন্ত্রী। তৃণমূল সরকারের একাধিক দফতরের মন্ত্রী হয়েছেন। মাঝে আবার উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে ‘ডক্টরেট’ হয়েছেন। মাথার চুলে কলপ করেন, জুলপিটি রাখেন সাদা। সঙ্গে ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটি রাখেন অতি যত্নে। দেখে বোঝা যেতনা, জীবন যাপনে এতটা যত্ন আর সুখকে লালন করতেন নিভৃতে। জীবন যাপনের মতো চুরির এত এত টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, জমিজমা, বাগানবাড়ি, আরও কত বিষয় সম্পত্তি লালন পালন করছিলেন গোপনে নির্জনে। এত কিছু যিনি চুরি বিদ্যার মতো মহাবিদ্যা থেকে অর্জন করেছেন তিনি  রিপুকে দমন করতে যাবেন কোন দুঃখে।

হোক না ৬৮ বছর বয়স আর ১২৩ কেজি ওজন কিম্বা বিশাল ভুঁড়ি। ক্ষমতা আর কোটি কোটি টাকা থাকলে সুন্দরী বান্ধবীর অভাব হয়না। পার্থরও হয়নি। এক নয় একাধিক, নায়িকা থেকে অধ্যাপিকা। কখনও বিশ্রাম নিতে বান্ধবীকে নিয়ে বারুইপুরের বাগানবাড়িতে, কখনও নির্জনতা খুঁজতেনশান্তিনিকেতনে। বিলাসপ্রিয় পার্থকে কখনও সখনও দেখা যেত কাঁথা স্টিচের চওড়া বুনোনওয়ালা পাড়ের মহার্ঘ ধুতি আর লাল পাঞ্জাবি সঙ্গে নাগরা জুতো পায়ে মসমসিয়ে ভিন্টেজ গাড়িতে চড়ে পুজো পরিক্রমায়, কখনও বিনোদনের মহাআসরে।

বিলাসে, বৈভবে ভরপুর পার্থর বিরুদ্ধে কিন্তু বেশ কিছুকাল ধরেই চুরি নয়, তবে তাঁর আচরণ নিয়ে দুর্বিনয়ের অভিযোগ উঠছিল। আজ দলের অনেকেই যেতাঁকে ছেঁটে ফেলতে চাইছেন তাদের কাছে কি এতকাল কোনও খবরই ছিল না? নেত্রীর কানে কি এতদিন কোনও কথাই পৌঁছয় নি? নাকি গোটা দলটাই আপদমস্তক চোর বলে আলাদা করে একজনকে চিহ্নিত করা কঠিন। তিনি যে পুজোর প্রাণপুরুষ, সেই পুজোর ব্যানারে ছেয়ে যেত গোটা শহর, সেই পুজোর ভিড়ের চাপে ২০১৮ সালের নবমীর রাতে পুলিস নেতাজি সুভাষ রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স মাঝপথ থেকে ফিরে গিয়েছিল। শহরে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে তাঁর পরোক্ষ অঙ্গুলিলেহনে। দল কিছুই জানতো না এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য?

তাঁর এক বান্ধবীর একটি ফ্ল্যাটে নগদ ২১ কোটি ৯০ লাখ, অন্যটিতে ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা, ৫ কোটি টাকার সোনা এবং বিদেশি মুদ্রা জমা হয়ে গিয়েছে। শান্তিনিকেতনে আরেক বান্ধবীর নামে অলকানন্দা, তিতলি, অপা ইত্যাদি বিভিন্ন নামের সৌখিন প্রায় ৯ টি বাড়ি। এছাড়া ডায়মন্ড সিটিতে তিনটে ফ্ল্যাট। বেলঘরিয়া ক্লাব টাউনে দুটো ফ্ল্যাট। বরাহনগরে একটি, নিউটাউনে দুটি, সোনারপুরে একটি, জঙ্গিপারায় একটি প্রাসাদেপম বাডি, পিংলায় কয়েক একর জমি কিনে ৪৫ কোটি টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে স্কুল নির্মাণ। বাঘা যতীন স্টেশনের কাছে ১৭ কাটা জমিতে পেট হসপিটালের জন্য জমি, বারুইপুরের বেগমপুরে প্রায় ২৫ বিঘে জমি, সিঙ্গুরে দুর্গাপুর হাইওয়েতে ব্রিজে ওঠার আগে নবান্ন হোটেলের পাশ দিয়ে সোজা গেলে ফার্ম হাউস।দক্ষিণ ২৪ পরগণায় সাত জেনিয়া দ্বীপের দয়াপুরে  নিউ সুরঞ্জনা, নিউ রয়াল বেঙ্গল রিসর্ট, আরও একটি রিসর্ট; একদিকে সজনেখালির জঙ্গল, অন্য দিকে পাখিরালয় পেছনে রেখে নদী যেখানে তিন ভাগ হয়ে যাচ্ছে ঠিক সেইখানে, গোসাবা দ্বীপের মধ্যে সোনার গাও রিসোর্ট, ঝাড়গ্রামে জঙ্গল লাগানো মনোরম পরিবেশে রিসর্ট…

এই হল দেশের একমাত্র আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিবের পরিচয়। যার বান্ধবীরা নায়িকা,অধ্যাপিকা ইত্যাদি ইত্যাদি, তাদেরটাকার পাহাড়, কোটি কোটি টাকার ফ্লাট, জমি, সোনা, বিদেশি মুদ্রা। কোথা থেকে এল এত টাকা, কাদের টাকা? তৃণমূল আমলে চাকরি পাওয়া অযোগ্য শিক্ষকদের নাকি যোগ্যতা অর্জন স্বত্বেও যারা চাকরি পায়নি তাদের চোখের জলের?  
Share.

3 Comments

  1. sirajul ahamed choudhury on

    সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে মমতার উত্থান শুরু। তাঁর পাশে পাশেই উঠছিলেন পার্থ। আজ এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতিতে কোটি কোটি টাকার লেনদেনে অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্রেস মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কি চমৎকার!

  2. bipratik paramanik on

    ‘আমি তৃণমূল কংগ্রেসের দুনম্বর গুরুত্বপূর্ণ। আমার আগে একমাত্র মমতা আছেন।’ পার্থ চট্টোপাধ্যায় এমনই দাবি করতেন ঘনিষ্ট মহলে। কিন্তু এখন তিনি ইডির হাতে গ্রেফতার।

  3. chandranath chhitmul on

    ওদিকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দিদি বলছেন, “তৃণমূল একমাত্র আদর্শবাদী দল”…আর বাংলার মানুষ দেখলো সেই দলের মহাসচিবকে আর তার বান্ধবীদের সম্পত্তি, টাকার পাহাড়, কোটি কোটি টাকার ফ্লাট ও জমি… এদের গায়ে থুতু দিলেও মনে হয় কিছু নয়, তার চেয়ে পায়ের জুতো দিয়ে মাড়ানোই ভালো

Leave A Reply

Exit mobile version