একাধিক বান্ধবী, বিপুল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, কুকুরের নামে ফ্ল্যাট, সরকারি ক্ষমতা সব মিলে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় ধৃত রসে-বশে থাকা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন ইডি হেফাজতে। পার্থর সাধের রটওয়েলার,  ইংলিশ বুলডগ,  ফ্রেঞ্চ বুলডগ, পাগ, বিগল, ল্যাব্রাডর ও গোল্ডেন রিট্রিভরেরা ডায়মন্ড সিটি সাউথ আবাসনের ১৯ তলায় কয়েকদিন ধরে অযত্নে অবহেলায় বন্দি পড়ে আছে। তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ও এখন ইডি হেফাজতে। উঠতি অভিনেত্রী ও মডেল অর্পিতা মুখোপাধ্যায় ছাড়াও পার্থর একাধিক বান্ধবী, তাদের আধিকাংশই অধ্যাপিকা। পার্থ নির্বাচনী হলফনামায় সম্পত্তির বিষয়ে তথ্য গোপন করেছিলেন। এখনও পর্যন্ত নামে বেনামে যতটুকু সম্পত্তির হদিস মিলছে তা পাঁচশো কোটিরও বেশি। এই সব বেআইনি অর্থ সম্পত্তি তিনি মজুত করতেন বান্ধবীদের কাছে। এই সব বান্ধবীরা কেবল পার্থ ঘনিষ্টই নন, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখতেন। 

পার্থ চট্টোপাধ্য়ায় ইডির হাতে গ্রেফতার হতেই তাঁর পিএইচডি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। দাবি করা হচ্ছে মন্ত্রী হিসাবে প্রভাব খাটিয়ে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলেন। অভিযোগ পর্যাপ্ত ক্লাস ওয়ার্ক না করে, অন্যের গবেষণাপত্র নকল করে তিনি পিএইচডি পেয়েছিলেন। পার্থর গবেষণার বিষয় ছিল, ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি টু নলেজ ইকোনমি, দ্য রোল অব হিউম্যান রিসোর্স উইথ রেফারেন্স টু ইন্ডিয়া। বিষয়টি কেবল পরিশ্রমসাধ্য নয়, যথেষ্ট সময় এবং মনোসংযোগনা থাকলে মাত্র কয়েক বছরে এই বিষয়ে নানা ব্যাপারে সারাদিনের জন্য ব্যস্ত একজনের পক্ষে পিএইচডি অর্জন করা অসম্ভব কাজ।

পার্থ গত ১১ বছর ধরে তৃণমূল সরকারের একাধিক দফতরের মন্ত্রীত্ব সামলেছেন, একই সঙ্গে দলের কাজ, পুজো কমিটি, নানা ধরণের রাজনৈতিক-সামাজিক অনুষ্ঠান, টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, জমিজমা, বাগানবাড়ি, আরও কত বিষয় সম্পত্তির লালন পালন, সুখ ও বিলাসিতার নিভৃত জীবন যাপনে বিশ্রাম নিতে বান্ধবীকে নিয়ে বাগানবাড়িতে, নির্জনতা পেতে শান্তিনিকেতনে, এছাড়া পুজো পরিক্রমা থেকে বিনোদনের মহাআসর তো লেগেই থাকতো, কখন তিনি গবেষণার সময় পেতেন?

এরপর বান্ধবীদের সঙ্গ। কেবল উঠতি অভিনেত্রী ও মডেল অর্পিতা মুখোপাধ্যায় তো নয়, এরপর যে নামটি উঠে আসছে তিনি কাজি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান মোনালিসা দাস। গত কয়েকদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি। ২০১৪ সালে পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী পদে থাকার সময়েই অধ্যাপিকা পদে যোগ দেন মোনালিসা দাস। দ্রুতই সহকারী অধ্যাপক থেকে বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে যান।শুধু নিজের নয়, শিক্ষা মন্ত্রীর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বহু অযোগ্য ব্যক্তিকে চাকরিও পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। এমনকি, বহু অযোগ্য ব্যক্তিকে গোল্ড মেডেল পাওয়ানোর পিছনেও হাত রয়েছে এই মোনালিসার।

শান্তিনিকেতন ও নদিয়ায় ১০ টিরও বেশি বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। শান্তিনিকেতনে তাঁর বিলাসবহুল বাড়ি ‘অপা’ দেখলে চোখ কপালে উঠবে যে কারও। প্রশ্ন,একজন অধ্যাপিকার আয়ে এত সম্পত্তি কীভাবে সম্ভব? সব কিছুই কি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বদান্যতায়? এছাড়াও বীরভূমে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের যে একাধিক বাড়ির হদিস মিলেছে, মোনালিসা সেগুলির দেখাশোনা করতেন। ২০২১-এর নির্বাচনে পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের প্রচারে পথেও নেমেছিলেন মোনালিসা। মাস কয়েক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন মোনালিসা।যথেষ্ট যোগ্যতা না থাকায় ইন্টারভিউয়ে ডাক পড়েনি তাঁর। এরপর নাকি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম করে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তিনি। প্রশ্ন, এত দিন ধরে এত অভিযোগ কি কারণে চাপা ছিল, স্রেফ মন্ত্রীর ঘনিষ্ট বান্ধবী আর তৃণমূলের সঙ্গে আছেন বলে?

তৃণমূল কংগ্রেস মহাসচিবের বান্ধবী তালিকায় আরও একটি নাম আলিপুরদুয়ারের শিক্ষক নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির রাজ্য সম্পাদক মৌমিতা অধিকারী। পার্থর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সুবাদে মৌমিতার দাপটে জেলার সাধারণ শিক্ষক শিক্ষিকারা সিঁটিয়ে থাকতেন। মৌমিতাকে এড়িয়ে বদলির কোনও সম্ভাবনা ছিল না। সুযোগসন্ধানী মৌমিতা বামফ্রন্ট আমলে ছিলেন বাম শিক্ষক সংগঠনে। সরকার পাল্টানোর পর তৃণমূল কংগ্রেসের শিবিরে চলে আসেন। সম্প্রতি তিনি বিজেপির দিকেও ঝুঁকেছিলেন। তবে বিধানসভা ভোটের পর উত্তরবঙ্গে বিজেপি ভালো ফল করলেও ক্ষমতায় টিএমসি থেকে যায়। মৌমিতা আর বিজেপিমুখো হননি।

পার্থর আরও এক বান্ধবী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা জরিনা খাতুন। তিনি যে কলেজের অধ্যাপিকা সেখানকার NOC না নিয়েই তাঁকে সোজা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। পাশাপাশি জরিনাকে পদ পাইয়ে দিতে পার্থবাবুর অনুরোধে রাজ্যের এক মন্ত্রীও উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাহলে মানেটা দাড়াচ্ছে কি? যোগ্য পার্থীরা চাকরি পাচ্ছেন নাআর অযোগ্যরা টাকার বিনিময়ে, মন্ত্রীর বান্ধবী হওয়ার কারনে চাকরি পেয়ে গেলেন। রাজ্যে জুড়ে এই দুর্নীতি প্রমাণ করে দিচ্ছে সরকার কতখানি সততার সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করছে। 

পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় মিমের বন্যায় অর্পিতা মুখোপাধ্যায়, মোনালিসা দাস, মৌমিতা অধিকারী ছাড়াও ছবি-সহ পার্থর আরও বান্ধবীদের ছবি ভাইরাল হতে থাকে। তাদের মধ্যে একজন হলেন ড. অহনা চক্রবর্তী। অপরজন হলেন দীপান্বিতা। অহনা চক্রবর্তী নদিয়ার শিমুরালি শচিদানন্দ কলেজ অফ এডুকেশন এর প্রিন্সিপাল। ২০১৮ সালে নদীয়ার এই কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু তার নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তাছাড়া এঁদের বিষয়ে ইডি-র তরফে এখনও কিছু বলা হয়নি। পাশাপাশি উঠে এসেছে অধ্যাপিকা সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।

প্রসঙ্গত, পার্থ চট্টোপাধ্যায় গোটা বাংলায় সমস্ত ট্রেনিং কলেজগুলিকে এক সূত্রে বাঁধতে সব ট্রেনিং কলেজগুলিকে নিয়ে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এন্ড প্ল্যানিং’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত হন মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে তাঁকে তাঁর পরিবর্তে নিযুক্ত হন সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কিভাবে ওই পদে এলেন,সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট উত্তর নেই। অথচ সোমাদেবীএকই সঙ্গে ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদেও রয়েছেন। কেউ কি কোনও দিন প্রশ্ন তুলেছেন কিভাবে দু-দুটি উপাচার্য পদ তিনি পেলেন? শুধুমাত্র পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেস দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বলে?
Share.

3 Comments

  1. ratan senapati on

    প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ‘অনুগ্রহ’তেই মোনালিসার ‘বেড়ে ওঠা’। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পদোন্নতি, মোনালিসার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করা ছাত্রছাত্রীদের ‘সুবিধা’ পাইয়ে দেওয়া, তাঁদের চাকরির ক্ষেত্রেও ‘অনুচিত অগ্রাধিকার’…

  2. pallab vadra on

    নতুন শিক্ষা বিলের মাধ্যমে ঘুরপথে নিজের পকেটে টাকা ভরছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। যে কারণে যোগ্যরা চাকরি পান নি কিন্তু অযোগ্যরা টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন। যেমন দল তেমনি তার মন্ত্রী।

  3. Parnali Banerjee on

    ইন্টারভিউয়ে ডাক না পেয়ে হুমকি, দ্রুত সহকারী অধ্যাপক থেকে বাংলা বিভাগের প্রধান, অযোগ্য ব্যক্তিকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কি স্রেফ একজন মন্ত্রীর বান্ধবী হলেই অর্জন করা যায় নাকি শাসক দলেরও কাছাকাছি থাকতে হয়?

Leave A Reply

Exit mobile version