রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে সিলেট গিয়েছিলেন মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাস আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সেখানে ছাত্রদের উদ্দেশে ‘আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা করেছিলেন। সেই বক্তৃতা একটি কিশোরের মনোজগতে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে কিছুদিন পর সেই কিশোর কাউকে না জানিয়ে কবিকে একটা চিঠি লিখেন। চিঠিতে তাঁর প্রশ্ন ছিল, ‘আকাঙ্ক্ষাকে বড়ো করার উপায় কী? কিছুদিন পর কবির নিজের হাতে লেখা চিঠির জবাব পান সেই কিশোর। রবীন্দ্রনাথের সেই চিঠির সূত্র ধরেই একদিন সেই কিশোর বিশবভারতীতে পড়তে শান্তিনিকেতন পৌঁছে যান।কিন্তু কিশোরটি ধর্মে মুসলমান, তখন একজন মুসলমান ছাত্রের পক্ষে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়া সহজ ছিল না। কারণ গেলেই তো হল হল না, শান্তিনিকেতনের রক্ষণশীল হিন্দুধর্মাবলম্বী আশ্রমিকরা কীভাবে নেন সেটাও একটা বিষয় ছিল। শান্তিনিকেতনে ছাত্র হিসেবে সেই কিশোরটি এসেছিলেন ১৯২১ সালে। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের ছাত্র এবং সর্বপ্রথম মুসলমান ছাত্র। ধর্মে মুসলমান সেই কিশোরের ভর্তির ব্যাপারে অনেক আশ্রমিকেরই আপত্তি ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো উদারনৈতিক, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ভাবনার ব্যক্তিত্বের ইচ্ছেতেই সব বাধা পেরিয়ে যায়।

শান্তিনিকেতনে আসা সেই নতুন ছাত্রটিকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম দেখে বলেছিলেন, ‘ওহে, তোমার মুখ থেকে তো কমলালেবুর গন্ধ বেরোচ্ছে!’ সিলেট কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত। সে কারণেই এমন সম্ভাষণ। ওই ছাত্রটিকে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে জিঙ্গাসা করেছিলেন, ‘বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসবেন কাঁচি হাতে করে?’ছাত্রটি খুবই অবাক হয়। তার ধারণা অনুযায়ী মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে, অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে। কাঁচি হাতে করে কেন আসবেন? রবীন্দ্রনাথ ছাত্রটিকে অবাক হতে দেখে বলেন, ‘হাঁ হাঁ কাঁচি হাতে নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু–মুসলমান আর কতদিন আলাদা হয়ে থাকবে?’ ওই কিশোরের নাম সৈয়দ মুজতবা আলি।

এই ঘটনার সুচনা অনেকদিন আগে। শান্তিনিকেতনের বোর্ডিং বিদ্যালয়ে একটি মুসলমান ছাত্রকে নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানকার প্রধান শিক্ষক নেপালচন্দ্র রায়কে বারবার অনুরোধ করেছিলেন। ছেলেটির নাম ছিল রবীন্দ্র কাজী। রবীন্দ্রনাথের আশংকা ছিল, আশ্রমের ট্রাস্টি দ্বীপেন্দ্রনাথের এতে আপত্তি হবে, নেপালচন্দ্রও তত উৎসাহ দেখাননি। নেপালচন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, মুসলমান ছাত্রটির সঙ্গে একটি চাকরি দিতে তার পিতা রাজি। এরপর কি হয়েছিল তা আর বিস্তারিত পাওয়া যায়নি। তবে শান্তিনিকেতনে প্রথম বা দ্বিতীয় মুসলমান ছাত্র মুজতবা আলী, তিনি শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান স্নাতক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে ১৯২১ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত যে তিনি শান্তিনিকেতনের কলেজের ছাত্র ছিলেন তা নিশ্চিত। 

প্রথম সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি পড়তে চাও? মুজতবা আলী বলেছিলেন, তা তো ঠিক জানিনে, তবে কোনো একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই। রবীন্দ্রনাথ বলেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী? আলী বলেন, মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনো জিনিস বোধ হয় ভালো করে শেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, একথা কে বলেছে? আলীর বয়স তখন সতেরো, থতমত খেয়ে বলে, কনান ডয়েল। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ইংরেজের পক্ষে এ বলা আশ্চর্য নয়।

বিশ্বভারতীতে মুজতবা আলী একবার রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নকল করে নোটিশ দিয়েছিলেন, ‘আজ ক্লাশ ছুটি’। সবাই মনে করেছিল রবীন্দ্রনাথ ছুটি দিয়ে দিয়েছেন! ঘটনা তারপর কতদূর গড়িয়েছিল জানা নেই। তবে জানা যায় রবীন্দ্রনাথের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কবিতা এবং ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রবন্ধ তাঁর মুখস্থ ছিল। আনন্দ বাজার পত্রিকার অন্যতম স্বত্বাধিকারী প্রফুল্ল চন্দ্র সরকারের শ্রাদ্ধ বাসরে নিমন্ত্রণ পেয়ে হাজির হয়েছেন মুজতবা আলী। উপস্থিত ব্রাহ্মণরা নাক সিঁটকেছে তাঁকে দেখে। আলী খেয়াল করলেন, গীতা পাঠে ভুল হচ্ছে, বললেনও সে কথা। তাই শুনে হিন্দু পণ্ডিতরা বললেন, তুমি মুসলমান, গীতার কি জানো হে? মুজতবা আলী গীতা না দেখে অনর্গল মুখস্থ বলে গেলেন ব্যাখ্যা সহকারে। আর সব চুপ!

তখন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী সম্মিলনী নামে ছাত্র ও শিক্ষকদের যে সমিতি গড়ে উঠেছিল, তার একাধিক অধিবেশনে তরুণ মুজতবা আলীকে নানা বিষয়ে যেমন প্রবন্ধ পড়তে হত, তেমনই এমন ঘটনাও বহুবার হয়েছে, সভাপতিত্ব করছেন রবীন্দ্রনাথ, মুজতবা আলী প্রবন্ধ পড়ছেন ঈদ উৎসব সম্বন্ধে। সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সভার শেষে প্রবন্ধ লেখককে ধন্যবাদ ও আশীর্বাদ জ্ঞাপন করছেন।  মুজতবা আলীর ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতন নিয়ে লেখার। জীবন সায়াহ্নে এসে অনেকের কাছে নিজের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেনও তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর তা লিখতে পারেননি।

জীবিকা নিয়ে অস্থির অবস্থার মধ্যে মুজতবা আলী কলকাতার পাট চুকিয়ে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। কলকাতায় এত পরিচিতজন থাকা সত্ত্বেও তাঁর কোনো কাজের ব্যবস্থা হলো না, এই বিষয়টি তাঁর মনঃপীড়ার কারণ হয়েছিল। তাই নিজের তারুণ্যের চারণভূমিতে গিয়েই স্বস্তি পেতে চাইছিলেন। শান্তিনিকেতনেও মুজতবা আলী মানসিকভাবে খুব শান্তি পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। আর্থিক কষ্ট তাঁকে থিতু হতে দিচ্ছিল না। তাছাড়া, তারুণ্যে দেখা শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুপরবর্তী শান্তিনিকেতনকে মেলাতে পারছিলেন না। সেই বন্ধুবৎসল পরিবেশ সেখানে তখন উধাও, সঙ্গ দেবার মতো বন্ধুরাও তেমন কেউ আর নেই। উল্টো চারিদিকে ঈর্ষাকাতরতা আর হীনম্মন্যতার প্রকাশ। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সাল অব্দি শান্তিনিকেতনে মুজতবার জীবননির্বাহ হত লেখালেখি থেকে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক দিয়েই।
Share.

2 Comments

  1. বিশ্বভারতীর উপাচার্য কালিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিরোধ যখন চরমে, বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্ত মুজতবা আলীর বিরুদ্ধে ক্লাসে অনিয়মিত উপস্থিতি, গবেষণায় গাফিলতি ইত্যাদি অভিযোগ উঠেছিল। অকস্মাৎ ১৯৬৫’র ৩০শে জুন তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অভিমানে মুজতবা আলী আশ্রম ছেড়ে চলে যান বোলপুরের নীচুপট্টিতে, আবদুর রউফের বাড়িতে। শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এসে অনেকেই সেখানে ‘চাচা কাহিনি’র লেখককে দেখতে যেতেন। দরজা খুলে নিজেই বলতেন ‘আলি সাহেব তো বাড়ি নেই’।

  2. ‘মুজতবা আলী পাকিস্তানের চর, তাঁর পরিবার থাকে পাকিস্তানে, তাঁর স্ত্রী পাকিস্তান সরকারের চাকুরে, তাহলে তিনি এখানে কেন?’ – এমন ধরণের কটুক্তি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নামে। আর তাতে তাল মেলায় শান্তিনিকেতনের একসময়ের বন্ধুরাও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে মুজতবা আলী লিখেছিলেন, “শান্তিনিকেতনে ভদ্রলোকের পক্ষে থাকা অসম্ভব, আমি সর্ব সম্পর্ক ছিন্ন করে দূরে বোলপুর শহরে থাকি।

Leave A Reply

Exit mobile version