নদী কাঁপিয়ে লঞ্চ ছাড়ছে। কালো ধোঁয়া যেন হঠাৎ ডাকা মেঘের মতো ঝুলে রইল মাথায়। তুমি চলে যাচ্ছো। তোমার চলে যাওয়াটা যেন শেষই হচ্ছে না। ছোট হয়ে যাওয়া স্টিমারটির দিকে ঠিক কতক্ষণ অপলক ছিল চোখ? পলকহীন, ভাষাহীন মুহূর্তে ডুবে সময়। সম্বিত ফিরতে নদীর বুকে শুধু ঘাস ফড়িংয়ের দুর্দান্ত ছোটাছুটি, প্রজাপতির পাখায় পাখায় আনন্দের রঙ আর আকাশজুড়ে সাদা মেঘের উপর ভালোলাগার ছড়াছড়ি। এই কয়েক মুহূর্তেই যেন ভালোবাসার বনভূমিতে চপলা হরিণ লুকোচুরি খেলেছে। ‘কিছু মনে কোরো না, সময় কোথা সময় নষ্ট করবার!’ মাঝমধ্যে এই লাইনগুলি কেমন যেন মোচড় দিয়ে যায়। বা ধরুণ পিঠে ব‌্যাগ নিয়ে নির্জন স্টেশনে এক শালিকের সঙ্গে একা আপনি দাঁড়িয়ে। ঝমঝমিয়ে একটি ট্রেন এল। থামল, চলে গেল। কেউ উঠল না, কেউ নামলও না। ওই শালিকটি উড়েও গেল না। ফাঁকা স্টেশনের দিকে তাকিয়ে বলল, বলে ফেলো। সহজ কথাটি বলে ফেলো। সত্যি-ই তাই, কঠিন করে অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু সহজ করে কোনও কিছুকে বলাটাই সবচেয়ে শক্ত কাজ। আমাদের মনের যে সহজ ভাবগুলো যা আমরা বলতে পারিনি, বা পারি না, বলেও বলা হয় না, সেই ভাবগুলিই তো আসল। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে। তোমাকে স্বপ্ন দেখতে সাহায‌্য করে। ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’

মাধ‌্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছি। মা জিজ্ঞাসা করলেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে। প্রতিবারই উত্তর দিতাম মোটামুটি। এই মোটামুটি কথাটি কিন্তু সরলভাবে বললেও, মোটেই সরল নয়। পুরনো মুখের প্রশ্নে তো আমরা প্রায়ই মুখস্ত বলি, ‘এই চলে যাচ্ছে’। এটাও কিন্তু সরল উত্তর নয়। আবার যদি আপনার প্রিয় মানুষটি আপনাকে সব জেনেও প্রশ্ন করে, ‘কী হয়েছে তোমার?’ প্রশ্নটা কিন্তু ভালোবাসার মতো সরল নয়। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আপনি-আমি যত কথা বলেছি, সবটাই কি ‘সরল’ কথা ছিল? বাতাসের সঙ্গে যে কথা, বৃষ্টির সঙ্গে যে কথা, কেলেঘাই নদীর সঙ্গে যে কথা, ঘুঙুর বাঁধা প্রিয় পায়ের সঙ্গে যে কথা সবই কী সরল ছিল! আপনি হয়তো বলবেন, ‘আমি তো কখনও কারও খারাপ চাইনি।’ কিন্তু আপনার ভালো চাওয়াটাও যে সব সময় ভালো হিসেবেই প্রকাশ পেয়েছে, তা হয়তো নয়। আবার বিকেল হবে / রোদ যাবে পড়ে / মানুষ মুখর হবে মাঠে আর ঘরে…। সত্যি যাতে আবার বিকেল হবে। সারাদিনের ব‌্যস্ততার পর হয়তো মিলবে কিছু ফুরসৎ। যে যার মতো করে বসবে খোলা বারান্দায়। সারাদিনের উপেক্ষার কথাগুলি হয়তো আসবে রাশিরাশি।  তখনই হয়তো মনে হবে, বলতে নেই, সব কথা সবাইকে বলতে নেই। জর্জ বার্নাড শ’ বলেছেন, ‘কেউ আপনাকে ততক্ষণ কিছু বলবে না, যতক্ষণ না আপনি তার সঙ্গে দ্বিমত হচ্ছেন। উল্টোটাও সত‌্য।’। আমিও তাই ভাবি। কী দরকার দ্বিমত করার। যত মত তত পথের সন্ধানে কাজ নেই। চিপকে থাকতে গেলে তোমার মতই আমার মত, একমেবদ্বিতীয়ম।

ভালোবাসা নিয়ে ভাবলেই মনে হয় বিবাদ এড়ানোই স্বর্গ। অথচ আমি সেই স্বর্গ থেকে বিতাড়িত। তারমানে ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ করেছি। ‘প্যারাডাইজ রিগেইন’ করার আকুতি যে নেই বলব না। কিন্তু একটা ধারায় বেড়ে উঠতে উঠতে সময়ের স্পিনে ব‌্যাটের কানা ছোঁয়ানোই দস্তূর। স্লিপে অনিবার্য ক‌্যাচ। প‌্যাভিলিয়নে ফিরে প‌্যাড, গ্লাভস ছুঁড়ে ফেলে নিমজ্জিত হও বরফ শীতল জলে। বেবি কুল কুল কুল। তুমি বেটা ফুল ফুল ফুল। ভাব-কেন্দ্রিকতার প্রতি আকুল নিয়ে যদি চলতে চাও, প্রশ্ন উঠবে, উঠবেই। ‘আধুনিক’ যুগের জন্মই তো হয়েছিল ভাব আর বস্তুর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। ‘রোমান্টিক’ যুগকে বিতাড়িত করে স্বর্গে পাঠানো হল, মর্তে পড়ে রইল ক্ষমতা পূজারিরা। মানো বা নাই মানো তাঁদের দৌড়-ঝাঁপ তোমাকে দেখতে হবে, হাততালি দিতে হবে। কারণ এই ‘আধুনিক’ যুগের নিষ্পত্তি পরকাল ছাড়া সম্ভব হবে না। আর অথচ দেখুন, বারে বারে হারানোর অভ‌্যাসেও এজন্মে আমি বারে বারে শুধু রাজা হতে চেয়েছি। প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটি রাজা বাস করে। মানুষ যখন লোভ এবং দম্ভ নামক রিপু দ্বারা তাড়িত হয়, তখন সেই রাজা হিংস্র হয়ে উঠে, মানুষ সেখানে খাটো করে নিজেকে, রুদ্ধ হয়ে যায় তার বিকাশ। আবার সেই মানুষই যখন ভালোবাসা পেয়ে মনুষ্যত্বের পথে হাঁটে, তখন সেই রাজা হয়ে ওঠে সুন্দর, মানুষের হয়ে ওঠার পথ হয় মুক্ত। যেমন ‘মুক্তধারা’য় ধনঞ্জয় বলে, ‘রাজা, ভুল করছ। এই যে ভাবছ জগৎটাকে কেড়ে নিলেই জগৎ তোমার হল। ছেড়ে রাখলেই যাকে পাও, মুঠোর মধ্যে চাপতে গেলেই দেখবে সে ফসকে গেছে’। আবার ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী যখন বলে, ‘তোমাদের রাজাকে এই একটা অদ্ভুত জালের দেওয়ালের আড়ালে ঢাকা দিয়ে রেখেছ, সে-যে মানুষ পাছে সে কথা ধরা পড়ে।…ইচ্ছে করে ঐ বিশ্রী জালটাকে ছিঁড়ে ফেলে মানুষটাকে উদ্ধার করি।’ কারও প্রায়োরিটির লিস্টে একা থেকে রাজত্ব করতে পারাটা বড় ভাগ্যের ব্যাপার। যেখানে অন্য কারোর রাজত্ব চলে না। মানুষটা থাকে একান্তই নিজের। এভাবেই কারও প্রিয়জন হয়ে থাকতে পারলে জীবনে আর অন্য কিছুই প্রয়োজন পড়ে না।

জীবনে শত মানুষের প্রয়োজন হতে পারার মাঝে কোনও মহত্ত্ব নেই, বরং একজন মানুষের প্রিয়জন হতে পারাটা গৌরবের। কারণ, প্রয়োজন বদলে যায়, প্রিয়জন নয়। তাহলে সেই প্রিয়জনের কাছেও কী সব কথা ইচ্ছামতো বলা যায় না? এক্ষেত্রেও সেই রবীন্দ্রনাথই ভরসা। রবীন্দ্রনাথের ‘রোগশয্যা’ কাব্যগ্রন্থের দশম কবিতা। ‘নীরবে শুনিবে মাথাটি করিয়া নীচু / শুধু এইটুকু আভাসে বুঝিবে, বুঝিবে না আর কিছু / বিস্মৃতযুগে দুর্লভক্ষণে বেঁচেছিল কেউ বুঝি / আমরা যাহার খোঁজ পাই নাই / তাই সে পেয়েছে খুঁজি’।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version