লক্ষ্মীপুজোর জন্য হাওড়া জেলার জয়পুরের খালনা অনেকের কাছেই খুব পরিচিত। এখানে যেমন অনেক পুরনো বাড়ির পুজো রয়েছে, তেমনই রয়েছে জাঁকজমকপূর্ণ বারোয়ারি লক্ষ্মীপুজো। অনেক পুজো হয় থিমের। আলোকসজ্জা এবং মণ্ডপ নির্মানে বৈচিত্র্য খালনা হাওড়া জেলার অনেক বড় দুর্গাপুজোকেও টেক্কা দেয়। হাজার হাজার মানুষ পুজো দেখতে এখানে ভীড় জমান। প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও লক্ষ্মীপুজোর রাতে ভেসে ওঠে আলোক মালায়। মানুষের ভিড়ে থইথই করে করে রাস্তা।বাগনান থেকে খালনা পর্যন্ত সারারাত গাড়ি চলে। নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।আলোকসজ্জা এবং মণ্ডপের বৈচিত্র্য ছাড়াও লক্ষ্মীপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পিরের দরগায় প্রার্থনা করে শুরু হয় জয়পুরের খালনার বাজারপাড়ার ‘আমরা সকল’-এর লক্ষ্মীপুজো। উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছেন হিন্দু-মুসলিম দুই সম্পদায়। প্রথম থেকেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলিত ভাবে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করে আসছেন। উভয় ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মিলনের ঐতিহ্য চলে আসছে বছরের পর বছর। কোনও ঘটনাই তাতে ফাটল ধরাতে পারেনি।মণ্ডপের খুঁটি পোঁতার আগে পিরের দরগায়ধূপ-মোমবাতি জ্বেলে, বাতাসা দিয়ে প্রার্থনা হয় যাতেপুজো ভাল ভাবে সম্পন্ন হয়।

সম্প্রীতির লক্ষ্মীপুজোর অন্য নজিরের নাম বাজারপাড়া। হাবড়া এলাকার বাঘাডাঙার পাড়ুইপাড়ায় দুর্গা নয় লক্ষ্মীপুজোই প্রধান উৎসব। আর সেই লক্ষ্মীপুজোকে কেন্দ্র করেই মেতে ওঠেন গ্রামের হিন্দু মুসললামান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। নূর ইসলাম, প্রশান্ত, আমিনা, প্রণতিরা। এই পুজো ঘিরে সাতদিন মেলাও চলে। কয়েক’শো পরিবারের মানুষ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল লক্ষ্মীপুজো।এই পুজো ঘিরে সাতদিন মেলাও চলে।পাড়ুইপাড়ার কয়েক’শো পরিবারের মানুষ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল লক্ষ্মীপুজো। গ্রামের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দাবি, এই লক্ষ্মীপুজোপাঁচশো বছর পুরনো তো হবেই।এখানে একটি স্থায়ী লক্ষ্মী মন্দির রয়েছে। অতীতে মন্দিরটি ছিল মাটি ও খড়ের। কয়েক বছর আগে সেটি পাকা হয়েছে। লক্ষ্মীপুজোতেই সকলে নতুন জামা কাপড় কেনেন। আত্মীয় স্বজনেরা বেড়াতে আসেন। কর্মসূত্রে যাঁরা অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন তাঁরাও বছরের এই সময়ে বাড়ি ফেরেন। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজোতে ওই গ্রামের মানুষ সে ভাবে সাড়া দেন না, লক্ষ্মীপুজোর জন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকেন। উৎসব বা আনন্দের কোনও রঙ হয় না। তাই এই গ্রামের হিন্দু মুসলমান উভয়েই লক্ষ্মীপুজো ঘিরে উৎসবে সামিল হন। ফলে বাজার পাড়ার লক্ষ্মীপুজো বহুকাল ধরেই সম্প্রীতির মিলন মেলা।

বর্ধমান শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে দায়েমনগর। এখানকার লক্ষ্মীপুজো আসলে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মিলন উৎসব। উত্তরে গলসি আর দক্ষিণে আউশগ্রামের সন্নিহিত এই এলাকায় হাত ধরাধরি করে পুজো চালু করেছিলেন হিন্দু ও মুসলমান— উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। গ্রামবাসীদের থেকেই শোনা, ১৯৮১ সালে দুর্গাপুজোর আয়োজন ঠিকঠাক না হওয়ায় খেত পাহারা দিয়ে পাওয়া পারিশ্রমিকের ধান সামন্তপাড়ার বাসিন্দাদের হাতে তুলে দেন কয়েকজন মুসলমান। সেই ধান বিক্রি করে লক্ষ্মী প্রতিমা আনা হয়। মুসললমান সম্প্রদায়ের মানুষ তখন রাতে খেত পাহারা দিত। তারাই বলেন, গ্রামের দুর্গাপুজো আর্থিক কারণে করা যাচ্ছে না শোনার পর তাদের মন খারাপ হয়। তখন সবাই মিলে ঠিক করেন, পারিশ্রমিক বাবদ পাওয়া ধান বিক্রি করে লক্ষ্মী প্রতিমা কিনে আনা হোক। যদিও এখন আর ক্ষেতে রাতপাহারা নেই। কিন্তু দায়েমনগরের লক্ষ্মীপুজোর প্রতিমা কেনেন মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরাই। গ্রামের মানুষেরা বলেন, লক্ষ্মীপুজো তো নামেই। আসলে গ্রামের উৎসব, সেখানে সবার অবাধ বিচরণ। এক সময়ে এই গ্রামে কোনও পুজো হত না। আশ্বিনে দূরের গ্রাম থেকে যখন ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসত, তখন গ্রামবাসীদেরমন খারাপ হয়ে যেত। সেই দুঃখ দূর করতে অনেক বছর আগে দুর্গাপুজোর আয়োজনের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু অনেক খরচ তাই পিছিয়ে যেতে হয়। সেই বিষন্নতা দূর করতে এগিয়ে এসেছিলেন যারা তাঁরা ধর্মে মুসলমান। তারপর দুই ধর্মের মানুষের চেষ্টায় শুরু হয় লক্ষ্মীপুজো। আউশগ্রামের দায়েমনগরে সেই পুজো আজও সম্প্রীতির আবহেই চলে আসছে।

যাতে ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাগাভাগি হিংসা চলতেই থাকে দেশজুড়ে তার আয়োজন শুরু করে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদী দল। তবু তার মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করে ভাতৃত্ববোধ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সেই শুভবুদ্ধির পদধ্বনি কান পাতলে শোনা যায়।এখনও অনেক মুসলমান ফকির লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে জীবিকা নির্বাহ করেন। অন্তত বেশ কয়েক দশক আগেও করতেন। তাঁদের পূর্বপুরুষরা যখন হিন্দু ছিলেন, তাঁদের জীবিকা ছিল লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে চাল-ডাল ও অর্থ সংগ্রহ করা। ধর্ম বদলে গেলেও, বংশপ রম্পরায় বদল হয়নি সেই জীবিকার।তেমন কথাই তো দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইতে লিখেছিলেন – ‘এখনও পূর্ববঙ্গের এক শ্রেণীর মুসলমানেরা লক্ষ্মীর পাঁচালী গাহিয়া জীবিকা অর্জন করিয়া থাকে। ‘প্রাতঃকালে ছড়া দেয় রে সাঁঝ হৈলে বাতি। লক্ষ্মী বলে সেই ঘরে আমার বসতি।’ ‘সতী নারীর পতি যেন পর্ব্বতের চূড়া। অসতীর পতি যেমন ভাঙ্গা নায়ের গুঢ়া”। কেবল দীনেশচন্দ্র সেন নয়,  ১৯৬৫ সালে ডক্টর ওয়াকিল আহমেদের লেখা ‘বাংলার লোক-সংস্কৃতি’ বইতেওসেই সব ফকিরদের কথা আছে, যাঁরা লক্ষ্মীর পাঁচালি গেয়ে ভিক্ষা করেন।
Share.

2 Comments

  1. asit ranjan malakar on

    বছরভর যে সম্প্রীতি বজায় থাকে, তা কি বিশেষ করে ফুটে ওঠে এই পুজোর সময়ে?

  2. shatabdi shankar on

    বর্ধমানের আউশ গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে মাথায় ফেজ টুপি পরে লক্ষ্মীপুজো পালন করেন।

Leave A Reply

Exit mobile version