তিনি আজীবন তাঁর মাতৃভাষা তুর্কিতে কবিতা লিখেছেন।হয়তো সে কারণেই তাঁর কবিতার অনুবাদ কিছুটা দেরিতেই পৃথিবীর নানা দেশে পৌঁছেছিল। তাঁর কবিতা সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছে রুশ ভাষায়, তার পরে ফরাসিতে এবং গত তিন দশকে সবচেয়ে বেশি হারে ইংরেজিতে। ইংরেজি জানা-বোঝা মহলে তাঁর কবিতার পাঠক সংখ্যা এমন ভাবে বেড়েছে যে, তাঁর স্বদেশীয় মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমীর মতো তিনিও আধুনিক ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যের ভুবনে বেশ কিছু কাল ধরে অতি প্রিয় নাম। অন্তত দশটি কাব্য-সংকলন, একাধিক জীবনী গ্রন্থ, স্মৃতিচারণা ও চিঠিপত্র নিয়ে তিনি ইংরেজিতে অনুবাদের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হন। কিন্তু সেই তিনি নিজেই তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন, অন্তত তিরিশ-চল্লিশটি ভাষায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু নিজের দেশ তুরস্কে, তুর্কি ভাষায়তাঁর লেখা নিষিদ্ধ। তুরস্কের সরকার ১৯৫১ সালেতাঁর নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। আর তাঁর মৃত্যুর ৪৬ বছর পর ২০০৯ সালে সেই নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। থচ সম্প্রতি ইস্তাম্বুলের এশিয়া অংশে চালু হয়েছে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে ‘পিরাইয়ে কাফ্যে’, একই সঙ্গে খোলা হয়েছে নাজিম হিকমত আকাদেমি, যেখানে প্রতিদিন সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষের ভিড় বাড়ছে।

পঞ্চাশের দশকের গোঁড়ায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতা প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। তিনি নাজিম হিকমতের কবিতা বইয়ের ভূমিকায় জানিয়েছিলেন যে, যদিও বেশিরভাগ কবিতাই ইংরেজিথেকে, কিছু কবিতা ফরাসি থেকেও অনুবাদ করা হয়। ফরাসি থেকে অনুবাদের কাজে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায় ও রণজিৎ গুহ (পরবর্তীতে নিম্নবর্গের ইতিহাস-খ্যাত)। সুভাষ তাঁর স্মৃতিচারণায় জানান, ১৯৫১/৫২ সালে কলকাতায়, তাঁর বন্ধু ডেভিড কোহেনের হাতে এসেছিল নাজিম হিকমতের একগুচ্ছ কবিতার ইংরেজি তর্জমা। খুব উচ্চাঙ্গের ইংরেজি না হলেও তা পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে জানা যায়না জিম হিকমতের কবিতার প্রথম ইংরেজি সংকলন বের হয় কলকাতা থেকেই—পরিচয় প্রকাশনী থেকে ১৯৫২ সালে। তার আগে ইংরেজিতে নাজিম হিকমতের কোনো কবিতা সংকলন প্রকাশ পায়নি। কেন এমন একজন কবির অমন সব কবিতার একটি সংকলন অন্য কোথাও না হয়ে প্রথম কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল? 

মনে করা হয়; গত শতকের পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে যখন আমেরিকায় ম্যাকার্থিবাদের প্রবল দাপট চলছিল। সিনেটর ম্যাকার্থিসর্বত্র কমিউনিজমের চিহ্নখুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।‘আন-আমেরিকান’ কর্মকাণ্ডের জন্য হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছিলেন লেখক আর্থার মিলার, এলিয়া কাজান, লিলিয়ান হেলম্যান, হাওয়ার্ড ফাস্ট, ডরোথি পার্কার, ইরউইন শ, ল্যাংস্টন হিউজ, সাংবাদিক উইলিয়াম শীরার, গায়ক পিট সিগার, নোবেল-জয়ী বিজ্ঞানী লাইনাস পাওলিং প্রমুখ কবি-নাট্যকার-শিল্পী-বিজ্ঞানীরা। এমনকি হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মুক্তচিন্তার নামে দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে সমর্থন জানাচ্ছেন। এই রকম অবস্থায় কমিউনিস্ট কবি নাজিম হিকমতের অনুবাদ আমেরিকায় প্রকাশ করা যে সম্ভব নয় সে কথা বলার অপেক্ষা থাকে না। তবু সেই পরিস্থিতিতে ছদ্মনামের আশ্রয় নিয়ে নাজিম হিকমতের কবিতা সেদিন অনুবাদ করেছিলেন নিলুফার ও রোসেট। অনুবাদক হিসেবে নাম ঠিক হয়েছিল আলি ইউনূস নাম। ‘আলি’ খুবই প্রচলিত, আর ‘ইউনূস’ ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর কবি ইউনূস এমরে-র নাম অবলম্বনে। দরবেশ কবিকুলের মধ্যে নাজিম হিকমতের খুব প্রিয় ছিলরুমি ও এমরের কবিতা। কিন্তুঅনুবাদ হলেও তাআমেরিকায় ছাপানো গেল না। সেই সময়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ভারতীয় ছাত্র; হতে পারে তাঁরা বাঙালি ও কলকাতাবাসী,নাজিম হিকমতের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে এতটাই মুগ্ধ হন যে সেই কবিতা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবিতা প্রেমীদের সমক্ষে আনার জন্য পাণ্ডুলিপির একটি অনুলিপি ডেভিড কোহেনের হাত মারফত পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। পরবর্তীতে ‘পরিচয়’ প্রকাশনী থেকে ১৯৫২ সালে ইংরেজিতে ‘নাজিম হিকমতের নির্বাচিত কবিতা’র প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয়। সেখানে ছিল নাজিম হিকমতের ৩৫টি কবিতা।

চে গুয়েভারার বলিভিয়া অভিযানের সঙ্গী রেজিস দেব্রে প্যারিসেনাজিম হিকমতকে একটি সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেন কীভাবে?’উত্তরে নাজিম হিকমত অনেক কথার মধ্যে বলেছিলেন,‘১৯ বছর বয়সে যখন মস্কোয় যাই আমার একমাত্র ইচ্ছে ছিল লেনিনের সঙ্গে দেখা করব, তাঁকে জিঙ্গাসা করবো, “আপনি কী করে বিপ্লব সমাধা করলেন তার রহস্য আমাকে বলুন।” আসলে আমার ইচ্ছে ছিল, লেনিনের কাছ থেকে এরকম কোনো গোপন চাবিকাঠি পকেটে নিয়ে আমি নিজ দেশ তুরস্কে ফিরে “বিপ্লব করে” দেশের মানুষের গরিবী ঘুচাব।’ লেনিনের সঙ্গে তাঁর কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু ১৯২৪ সালে লেনিনের অগণন শোক মিছিলের মধ্যে তিনিও ছিলেন।

ইলিয়া এরেনবুর্গ জানান, বিংশ শতাব্দীতে আর কোনো কবিকে নাজিম হিকমতের মতো এতো আইনি মামলায় হেনস্তা করা হয়নি, এতবার গ্রেপ্তারও করা হয়নি, যদি সব কারাদণ্ডের আদেশ বহাল হততাহলে ৫৬ বছরতাঁকে জেলে থাকতে হত। নীল চোখেরসোনালী চুলের কবি রাষ্ট্রের জন্য এতটাই বিপজ্জনক ছিলেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version