২০১৭-র পর আর নতুন হয়নি। কারণ থামতে হয়েছিল। তার আগে একটানা ৫৫ বছর ধরে‘হাঁদা ভোদা’ লিখেছেন ও এঁকেছেন। নারায়ণ দেবনাথ জনি হার্টের ‘বিসি’ কিম্বা হ্যাঙ্ক কেচামের ‘ডেনিস দ্য মেনেস’-এর একটানা ৪৩ ও ৪৯ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন।মাসিক পত্রিকা ‘শুকতারা’-য় ১৯৬২ সাল থেকেযে ‘হাঁদা ভোঁদা’ বেরতো তার সম্পূর্ণ কৃতিত্বটি অবশ্য নারায়ণবাবুর একার নয়।‘শুকতারা’-য় ১৯৫০-এর দশকে হাঁদা-ভোঁদাকে নিয়ে অনিয়মিত ভাবে একটি কমিক স্ট্রিপ বের হত,সেখানে কথা ও ছবির জায়গায় থাকত একটি বোলতার ছবি। সেটির শিল্পী ছিলেন প্রতুলচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। ১৯৬২ সালে ওই হাঁদা-ভোঁদাকে পরিমার্জন ও সংশোধন করেই নিয়মিত রচনা ও অলঙ্করণ শুরু করেন নারায়ণবাবু।

হাঁদা-ভোঁদাকে নিয়ে নারায়ণের প্রথম কাজটি ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ নিয়ে ‘হাঁদা ভোঁদার জয়’। কেবল ‘হাঁদা ভোঁদা’ কেন, পরবর্তীতে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’,‘নন্টে ফন্টে’, ‘পটলচাঁদ দি ম্যাজিশিয়ান’, ‘বাহাদুর বেড়াল’, ‘ডানপিটে খাদু আর তার কেমিক্যাল দাদু’এবং ‘পেটুক মাস্টার বটুকলাল’-এর মতো অসাধারণ সব লেখা ও আঁকা; সেগুলির কথাও তো বলতে হয়।

এখনও কী বাংলা সাহিত্যে কমিক শিল্পীরা খুব একটা কদর পান? কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক, গীতিকারদের তুলনায় বেশ কম। নারায়ণ দেবনাথ কি সে কারণেই নিজেকে কার্টুনিস্ট বা কমিকস আর্টিস্ট-এর চেয়ে শিশু সাহিত্যিক পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। অবশ্য তিনি তো কেবল আঁকেননি, গল্পও লিখেছেন। বলা ভাল, একই সঙ্গে লেখা ও আঁকার দায়িত্ব তাঁর মতো করে আর কেউপালন করেননি। তবু আমরা সাহিত্যে তাঁর অবদান মুক্তকন্ঠে স্বীকার করিনি।

হাওড়া জেলার শিবপুরের ছেলে নারায়ণের পৈতৃক নিবাস ছিল মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল সময়ে মাঝপথে লেখাপড়ার ইতি টেনেভর্তি হয়েছিলেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের পেইন্টিং বিভাগে। খুব দ্রুত রপ্ত করে ফেলেছিলেন শিল্পকলার কলাকৌশল। পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসায় মাঝেমধ্যেই করতেন সোনার গয়নার ডিজাইন। সব মিলিয়ে তাঁর ছবি আঁকার হাত ছিল বেশ পোক্ত।

শিল্পকলার পোকা মাথায় ঢুকে পড়ায় অন্য কাজে আর মন বসেনি। ভাগ্যের অন্বেষণে সেই কাজের খোঁজেই নেমে পড়েন। স্বভাবতই প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর চলার পথ একেবারেই মসৃণ ছিল না। মনের মতো কাজও জোটাতে পারেন নি। তবে বিকল্প কোনও পেশার কথাও ভাবেন নি।সাবান, মাথার সুগন্ধী তেল ইত্যাদির লোগো, মাস্টহেড আর সিনেমা কোম্পানির লিফলেটের কাজ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এই সব কাজের ফাঁকে একটি বাংলা অনুবাদের অলঙ্করণ সেরে ফেলেন। এই সময়ে তাঁর হাতে এসে পড়ল ‘শুকতারা’পত্রিকা।

ঠিক এমন একটি পত্রিকাতেই কাজ করা তাঁর স্বপ্ন। স্বপ্ন পূরণ করতেএকদিন কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় ‘শুকতারা’পত্রিকার প্রকাশন সংস্থা ‘দেব সাহিত্য কুটির’– এর কর্ণধার সুবোধ মজুমদারের সঙ্গে দেখা করলেন। নারায়ণবাবুর প্রতিভা বুঝতে সুবোধবাবু দেরি করেন নি। তাঁকে তিনটি অলঙ্করণের দায়িত্ব দিলেন। খুব দ্রুত সেই কাজ সেরে হাজির করলেন সুবোধবাবুর সামনে। সুবোধবাবু তৎক্ষণাৎ তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন পারিশ্রমিক।

হাঁদা ভোঁদা’র জন্যঅবশ্য নারায়ণবাবুকে উসকেছিলেন সুবোধবাবু ছোট ভাই ক্ষিরোদবাবু। ছোটবেলায় শিবপুরের রকে বসে দেখা পাড়ার কিশোরদের দুষ্টুমি নিয়ে একটি গল্পআর তার খাপে খাপে হাঁদা-ভোঁদার চরিত্র বসিয়ে হয়ে গেল ‘হাঁদা ভোঁদার জয়’। মনে রাখতে হবে ‘হাঁদা ভোঁদা’যখন শুরু হয়েছিল, তখন বাংলা ভাষায় কমিকস ছিল না বললেই চলে। এরপর বাঁটুল গোলাপি রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি আর কালো হাফপ্যান্ট, ৪০ ইঞ্চি বুকের ছাতি, কাঠির মতো সরু ও খালি পা- আর বাঁটুলের সঙ্গে তাঁর দুই ভাগ্নে, ভজা ও গজা জমিয়েদিল। এরপর ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার জন্য হাঁদা ভোঁদা-র আদলে তৈরি করলেন ‘নন্টে ফন্টে’। শুরুর দিকে এই কমিক স্ট্রিপের দুই কিশোর হুবহু হাঁদা-ভোঁদার মতোই ছিল। কিন্তু তারাও অনেকটা বদলে যায়। যোগ হয় নন্টে-ফন্টের হোস্টেল জীবন, হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট আর কেল্টুদার মতো চরিত্র।

‘হাঁদা ভোঁদা’,‘নন্টে ফন্টে’ প্রায় একই রকম চরিত্র।হয়ত সে কারণেই নারায়ণ জাদুকর পটলচাঁদ; যে তার মেধা দিয়ে সমস্যার সমাধান করে, অদ্ভূত ও বুদ্ধিমান একটি প্রাণী-বাহাদুর বেড়াল চরিত্রগুলি নিয়েএক ধরণের পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। ডানপিটে খাদু আর কেমিক্যাল দাদু, বটুকলালও উল্লেখের দাবি রাখে। এছাড়া আছে গোয়েন্দা কৌশিক রায়কে নিয়ে তার নিজের লেখা ১৪টি গল্পের ধারাবাহিক, এবং দিলীপ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘ইন্দ্রজিৎ ও ব্ল্যাক ডায়মন্ড’

এই সব কাজের জন্য নারায়ণ দেবনাথ একে একে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি, বিদ্যাসাগর পুরস্কার এমনকি বঙ্গবিভূষণ। একমাত্র ভারতীয় কার্টুনিস্ট হিসেবে ডি.লিটও পেয়েছেন তিনি। তবু মনে হয় আরও অনেকের মতো অনেক মানুষ তার নাম জানেন নি, তিনি একা পড়েছিলেন শিবপুর রোডের একটি দোতলা বাড়ির একতলায়। স্বীকৃতিও জুটেছে অনেক দেরিতে, কেন? তবে নিজের কাজের বাইরে অন্য কিছুর পিছনে কখনো ছোটেন নি।
Share.

2 Comments

  1. tushar kanti bhattacharya on

    হাঁদা ভোঁদা ছাড়া শৈশবের কথা ভাবা যায় না। সঙ্গে নন্টে ফন্টে তো ছিলই।

  2. arpan sengupta on

    নারায়ণ দেবনাথ একটা যুগ, একটা সংস্কৃতি, যেটা বাংলা থেকে অনেক দূরে মিলিয়ে গেছে, এখন শুধু স্মৃতি আউড়ে যাওয়া।

Leave A Reply

Exit mobile version