এ দেশে রোজার মাসকে উৎসবের আমেজ দিয়েছে মোগলরা। পবিত্র রমজানকে স্বাগত জানানো থেকে শুরু করে ইফতারে বিভিন্ন স্বাদের বৈচিত্র্যময় খাবার দিয়ে ভরিয়ে তোলার রেওয়াজটা তাদেরই। যা দিল্লি, লক্ষ্ণৌ ও হায়দরাবাদ হয়ে বাংলায় পৌঁছেছে। আদতে মোগলদের শাহি বাবুর্চিখানা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের রাজা–বাদশাহদের চেয়ে ‘বহুত উমদা’ ছিল। কেবল সম্রাট শাহজাহানের খাস বাবুর্চিই শতাধিক কিসিমের পোলাও রান্না করতে জানতেন।

আওরঙ্গজেব ও বাহাদুর শাহ জাফরের সময় এই ইফতারে সাধারণ মানুষ দরবারি খাবার চেখে দেখার সুযোগ পায়।আর তখন থেকেই মোগল মহলের নানা শাহি খাবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তা না হলে সিরিয়া ও লেবাননের হারিসা মোগলদের রান্নাঘরে ঢুকে ভারতীয় মসলার ঘ্রাণে বিলীন হয়ে হালিম নাম ধারণ করত না; আর হায়দরাবাদ হয়ে তা বাংলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার মওকাও পেত না। 

মোগল জমানার শেষে জালেবি বা জিলাপির মতো বনেদি খাবারও সাধারণ মানুষের ইফতারের থালায় উঠে আসে। শিরমাল কিংবা শিরবেরেঞ্জ হয়ে ওঠে বাংলার মুসলমানদের ইফতার ও সাহ্‌রির ফেবারিট আইটেম।

মোগল আমলের রোজা বা ইফতারের আয়োজন জানতে রাজকর্মচারী ও ব্রিটিশ লেখকদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেই সব বইপত্র থেকে জানা যায়, শবে বরাতের পর থেকেই রমজান তথা রোজার ইফতার ও সাহ্‌রির জন্য মানুষের মধ্যে দিন গোনা শুরু হতো। এরপর রোজার মাসের চাঁদ উঠলে বাহাদুর শাহ জাফর হাতি নিয়ে বের হতেন চাঁদ দেখতে। আকাশে একফালি চাঁদ দেখা গেলে কামান থেকে তোপ ছুড়ে এবং ফাঁকা গুলি করে রমজানের আগমনী বার্তা জানান দেওয়া হতো। পরবর্তীতে বাংলার সুবেদাররাও কামান দেগে, তোপধ্বনির মাধ্যমে রোজাকে স্বাগত জানানোর রেওয়াজ শুরু করেন।

ইফতারে মোগল ও বাংলার নবাবদের খানাপিনায় থাকতো শরবত, নান, কাবাব, বিরিয়ানি, কোফতা, কোরমা, হালিম, জিলাপি, নিমকপারা ও সমুচার মতো কিছু ভাজাপোড়া।নানের মধ্যে বিখ্যাত ছিল নানে তাফতান, যা বিভিন্ন ধরনের বাদাম দিয়ে তৈরি হতো।মোগলদের হাত ধরেই আগ্রা থেকে বাংলায় আসে বিখ্যাত শিরমাল। সুজি দিয়ে তৈরি করা খাবারটি এ অঞ্চলের ইফতার ও সাহ্‌রিতে অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও মোগলরা কাবাব দিয়েই খেত। কখনো রুটির সঙ্গে যোগ হতো নানখাতাই। তবে সাধারণ মানুষ চাপটি আর রুটিতেই সেরে ফেলতেন তাঁদের রোজাখোলাই। 

দ্য মোগল ফিস্ট: রেসিপিস ফ্রম দ্য কিচেন অব এম্পারার বইয়ে মোগল হেঁশেলের নানা কিসিমের কাবাবের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল পারসান্দের শিক কাবাব। ভালো গোশতের দশ–বারো টুকরা দিয়ে কয়লার আগুনে পোড়া এই কাবাব যে কারোরই জিবে জল আনতো। কাবাবটি পরবর্তী সময়ে সুলতানি কাবাব নামে পরিচিতি পায়। 

মোগলদের আমলের শেষে রোজার মাসে বাংলায় আরেকটি খাবারের খুব কদর ছিল—মোরগ মোসাল্লাম। মোরগে প্রয়োজনীয় মসলা দেওয়ার পর সেদ্ধ ডিম ভেতরে পুরে সুতা পেঁচিয়ে শিকে গেঁথে খাবারটি ফোঁটা ফোঁটা ঘি দিয়ে সরাসরি আগুনের শিকায় সেঁকা হতো। তারপর পুরোটাই রাখা হতো ইফতারির বরতনে। এ ছাড়া ইফতারে শামি কাবাব, হান্ডি কাবাব, টিক্কা কাবাব, তাশ কাবাবের মতো নানা ধরনের কাবাব যোগ হয়।

মোগল বাবুর্চিখানায় বহু রকমের বিরিয়ানির খোঁজ পাওয়া গেলেও ইফতারে তাঁরা সাধারণত কোন ধরনের বিরিয়ানি পছন্দ করতেন, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া না গেলেও বাংলার নবাবেরা যে রমজানে সিন্ধি বিরিয়ানি, লক্ষ্ণৌয়ি বিরিয়ানি, তেহারি ও মোরগ–পোলাও খেতেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলায় ইফতারে খোরাসানি পোলাও ছিল অন্যতম। যার বৈশিষ্ট্য ছিল এক বাড়িতে এই পোলাও রান্না হলে পুরো মহল্লায় তার সুরভি ছড়িয়ে পড়ত। রমজান মাসে দুধ, মধু, কিশমিশ ও মাওয়া দিয়ে শির বেরেঞ্জ নামে বিশেষ একটি খাবার তৈরি করা হতো। এটি খাওয়া হতো ইফতার ও সাহ্‌রি—দুই বেলাতেই। তবে সেকালে রোজার সময় সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্য ছিল শরবতে। একেক ধরনের বাদাম দিয়ে তৈরি হতো একেক ধরনের শরবত। আর এসব শরবতে দেওয়া থাকত জাফরান আর দামি সুগন্ধি।

পয়লা রমজানে মসজিদে ইফতারি পাঠানোর রেওয়াজটা শুরু হয় সতেরো শতকের পরে। প্রথম রমজান ও ২৭ রমজানে ইফতারির বড় ডালা পাঠানো হতো মসজিদে মসজিদে। আত্মীয়স্বজন ও মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজটা মূলত তখন থেকেই চালু হয়। সে সময় নতুন বরের বাড়িতে ইফতারির ডালা পাঠানো একপ্রকার বাধ্যতামূলকই ছিল। মোগল নবাবেরা মুসাফিরখানা ও বিভিন্ন মসজিদে বিনা মূল্যে ইফতার করাতেন, যার ঐতিহ্য এখনো দিল্লি জামে মসজিদে টিকে আছে। মুর্শিদাবাদের নবাব এস্টেটে কিছু কাল আগেও শত শত মানুষকে সাহ্‌রি ও ইফতার করানো হতো।

ইফতারকে তখন রোজাখোলাই বলা হতো। আর রোজাখোলাইয়ের বড় অনুষঙ্গ ছিল শরবত। শবেবরাতের পর থেকেই মাটি বা কাসা-পিতলের কলসিগুলি ধুয়ে মছে গোলাপ জল মাখিয়ে সুবাসিত করা হতো। তখন বরফকল ছিল না বলে কলসিগুলি নানান পদের শরবত দিয়ে পূর্ণ করার পর মুখ বন্ধ করে কুয়োর ভিতর ডুবিয়ে রাখা হতো। ইফতারের আগে আগে সেগুলি কুয়া থেকে তুলে আনা হতো কারণ ততক্ষণে সেগুলো ঠান্ডা হয়ে যেত। শরবতের প্রধান উপকরণ হতো দুধ, সঙ্গে মেশানো হতো বাদাম, কিশমিশ, পেস্তা, জাফরান ইত্যাদি।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version